তারেক আউট, ডিশ আলম ইন: বিএনপির রাজনীতি ও আন্দোলনের ভার এখন ডিশ আলমের কাঁধে

0
597
ডিশ আলম

বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমান ধীরে ধীরে বিস্মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। বুধবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বিএনপির পলাতক চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘বিএনিপর নেতা বিদেশে পালিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করে আর কর্মীদের বলে রাজপথে থাকতে! আমরা বলি—দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না।’ এই বক্তব্যটি দেশজুড়ে ভাইরাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এমনকি সাদ্দামের এই বক্তব্য ভাবাচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীদেরও।

সত্যিই তো, বিদেশে নিজে রাজকীয় জীবন-যাপন করে দলের নেতাকর্মীদের ঠেলে দিচ্ছেন অনিশ্চয়তার মুখে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে গুঞ্জন চলচে নতুন উদ্যমী নেতৃত্ব নিয়ে। কিন্তু বিএনপির মেরুদন্ডহীন কেন্দ্রীয় নেতাদের কারণে তৃণমূল থেকে উৎসারিত দাবি কখনই হালে পানি পায়নি। তবে সাদ্দাম হোসেনের এই বক্তব্যের ভিডিও ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের অনেক ত্যাগী, পরীক্ষিত কিন্তু বঞ্চিত নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে প্রশ্ন রেখেছেন- তারেক রহমান কি পারবেন ছাত্রলীগ সভাপতির এই বক্তব্যের উপযুক্ত জবাব দিতে? তাদের সেসব পোস্টও ভাইরাল হয়েছে ইতিমধ্যে। এতে একটা বিষয় স্পষ্ট, তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আস্থা নেই এখন আর।

তাহলে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী? এমন প্রশ্ন উঠছে অনেকদিন ধরেই। তবে বিএনপিও হয়ত নেতৃত্বের সংকটের বিষয়টি বুঝতে পারছে। আর তাই বিএনপিকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়া সুশীল সমাজ বিকল্প রাস্তা দেখিয়েছেন। বাংলা প্রবাদ রয়েছে- নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা। অর্থাৎ নিজের ক্ষতি করে হলেও পরের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা নেয়া। বিএনপিও তাই তারেক রহমানের ‘নটোরিয়াস’ ইমেজ ধামাচাপা দিয়ে সওয়ার হয়েছে নতুন ত্রাণকর্তার ঘাড়ে। বিএনপির সেই ত্রাণকর্তা হলেন আশরাফুল আলম ওরফে ডিশ আলম ওরফে হিরো আলম ওরফে টিকটক আলম ওরফে দৌড় আলম।

সম্প্রতি ঢাকা-১৭ আসনে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলেন ডিশ আলম। ফলাফল অনুমিত ছিল। ডিশ আলম মূলত ভাইরাল হওয়ার আশাতেই নির্বাচনে নেমেছিলেন, এমন কথা প্রার্থীতা ঘোষণা করার সময় থেকেই শোনা যাচ্ছিল। নির্বাচনের আগে ৭০-৭৫ জন ইউটিউবার ও টিকটকার পরিবেষ্টিত হয়ে ডিশ আলম বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নানারকম চটকদার বক্তব্য-বিবৃতি প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয়দের সাথে বাক-বিতণ্ডায় জড়ান এবং এক পর্যায়ে স্বেচ্ছা-লাঞ্ছিত হন। তার নিয়োজিত ইউটিউবাররা সেসব ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ও ইউটিউবে প্রচার করে দেদারসে অর্থ উপার্জন করে নিয়েছেন। তবে এই অর্থ উপার্জনই ডিশ আলমের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। রথ দেখা ও কলা বেচার মত তার এই নির্বাচনী খেলায় বহুমুখী উদ্দেশ্য ছিল।

জানা যায়, ঢাকা-১৭ আসনের মত ভিআইপি এরিয়ায় বগুড়ার ভোটার ডিশ আলমকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর পেছনে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে বিএনপি। এজন্য বিএনপির কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা ছাড়াও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নাম শোনা গেছে। যারা ডিশ আলমকে শুধু অর্থ সরবরাহই করেননি, এমনকি তাকে নির্বাচনি এজেন্টও দিয়েছেন।

অথচ ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় নির্বাচনের দিন ডিশ আলম নিজেই তার এজেন্টদের চিনতে পারছেন না, তিনি জানেন না তার হয়ে কারা এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন, এমনকি কয়েকজন এজেন্টের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, তারা জানিয়েছেন, তারা আসলে কোন প্রার্থীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন, তাকে চেনেন না। কেউ প্রতীকের নাম বলতে পারলেও প্রার্থীর নাম আশরাফুল আলম হওয়ায়- সেই ব্যক্তি যে ডিশ আলম, তা জানতেন না। এছাড়া কয়েকজন এজেন্ট জানিয়েছেন, তাদেরকে এলাকার কয়েকজন ‘বড়ভাই’ টাকা দিয়ে এজেন্ট হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এমনই ছিল সেই ডিশ আলমের নির্বাচনি প্রস্তুতি!

[তারেক আউট, ডিশ আলম ইন: বিএনপির রাজনীতি ও আন্দোলনের ভার এখন ডিশ আলমের কাঁধে]

সেই ডিশ আলম নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে ৭০-৭৫ জন ইউটিউবার নিয়ে প্রবেশ করতে চাইলে সেখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে সাধারণ ভোটারদের ওপর ইচ্ছেকৃতভাবে চড়াও হয়ে একটা ভাইরাল ইস্যু তৈরির চেষ্টা করে টিম ডিশ আলম। একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ভোটাররা ডিশ আলমকে নিয়ে আগ্রহ না দেখালেও পরিকল্পনা অনুসারে ডিশ আলম তার টিম নিয়ে স্লো মোশন ভঙ্গিমায় দৌড়ের অভিনয় করেন। তার ইউটিউবার টিমও তাকে অনুসরণ করে।

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় ডিশ আলমকে ক্যামেরার ফোকাসে রেখে তাকে ধাওয়া ও দৌড়ানোর আবহ তৈরি করা হয়, একপর্যায়ে িডশ আলম একটি থেমে থাকা রিক্সায় ওঠার চেষ্টা করেন কিন্তু ভাড়াটে ইউটিউবাররা বলেন এতে ফুটেজ ভালো আসছে না, তাই ডিশ আলম আবার নেমে ক্যামেরার ফোকাসে থেকে দৌড়ানোর নাটক করেন। এই পুরো পরিকল্পনার সাথে বিএনপির সাইবার টিম সম্পৃক্ত ছিল বলে ইতিমধ্যেই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে কিছু তথ্য-প্রমাণ এসেছে।

তবে এগুলো মূল ঘটনা নয়, এগুলো হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলিমেন্ট। আসল ঘটনা ঘটে এরপর। ডিশ আলমের মত ‘নিরীহ’ প্রার্থীর ওপর সরকারদলীয় সমর্থকরা চড়াও হয়েছেন দাবি করে ভিত্তিহীন, মনগড়া, অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা রটনা পেশ করা হয়েছে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস-এর ডেস্কে। এই নালিশনামা পাঠিয়েছেন বিএনপির বিদেশবিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সদস্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, শামা ওবায়েদ গং।

গোয়েন লুইস এই মুহূর্তে বাংলাদেশে না থাকায় বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন। আর এই সুযোগটি লুফে নিয়েছেন বিএনপির নেতারা। শেলডন ইয়েট- বিএনপি নেতাদের সাজানো ছকে পা দিয়ে ডিশ আলম ইস্যুতে উদ্বেগ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এমন প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ সরকার সহজভাবে নেয়নি। ফলে শেলডন ইয়েটকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছে।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শেলডন ইয়েটকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আসাদ আলম সিয়াম অসন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘ যেন প্রকাশ্যে এ ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে- সরকারের এমন প্রত্যাশার কথা সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য থেকে জাতিসংঘ বিরত থাকবে- বাংলাদেশ সরকারের এমন প্রত্যাশার কথাও তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে জাতিসংঘের কোনো প্রতিনিধিকে তলব করে অসন্তোষ প্রকাশের নজির নেই।

[তারেক আউট, ডিশ আলম ইন: বিএনপির রাজনীতি ও আন্দোলনের ভার এখন ডিশ আলমের কাঁধে]

এখানেই শেষ হয়নি ঘটনা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেভাবে ইতিপূর্বে নিজের সাক্ষর করা চুক্তিপত্রে বিদেশি লবিস্ট ফার্মগুলোকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন, এবারও ঠিক একই কাজ করা হয়েছে। বিএনপির গুজবসেল-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে কুখ্যাত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলামকে কাজে লাগানো হয়েছে। মাইলামের নিজেরই লবিস্ট ফার্ম রয়েছে। গত দুই বছরে মাইলামকে দিয়ে অনেকগুলো কাজ করিয়েছে বিএনপি। বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে নানারকম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাময় বিবৃতি, সাবেক কূটনৈতিক, সাবেক তারকাদের দিয়ে চিঠি লেখানো- এ ধরণের কাজগুলো মাইলামের লবিস্ট ফার্ম করে।

২০২১ সালে বিএনপির গুজবসেল-এর সদস্য কনক সরওয়ার, জ্যাকব মিল্টনদের সাথে একটি রেস্তোরাঁয় বৈঠক ও আর্থিক লেনদেন করছেন মাইলাম, এমন ছবি ফাঁস হয়েছিল। সেই মাইলামকে দিয়ে এবার ১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূতকে দিয়ে বিবৃতি দেয়ানো হয়েছে। তারা তাদের কূটনৈতিক দায়বদ্ধতা ও শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে ডিশ আলম ইস্যুতে নাক গলিয়েছেন। ১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূত যেভাবে বিবৃতি দিয়েছেন, তা রাজনৈতিক দলের মতো। তাদের জোটবদ্ধ হয়ে বিবৃতি প্রদান রাষ্ট্রদূতদের আচরণবিধি তথা ভিয়েনা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

ভারত কিংবা পাকিস্তানে যখন সহিংসতা হয়, পশ্চিমবঙ্গে চলমান নির্বাচনে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায়, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনকরা ভয়াবহ সহিসংতা ও খুন-খারাবির মত ঘটনাগুলোতে যেখানে বাংলাদেশি নাগরিকরা প্রাণ হারাচ্ছে, এসব সহিংসতায় জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রদূতরা এভাবে বিবৃতি দেন না কেন? এই প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। অথচ বাংলাদেশে এভাবে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে।

কারণ বিএনপি ও সুশীল সমাজের লোকজন এগুলো দেওয়ার জন্য তাদেরকে প্ররোচণা দেয়। এর আরেকটা প্রমাণ হলো, রাষ্ট্রদূতদের বিবৃতি সরকারের কাছে দেয়া হয়নি, তারা সরাসরি বাংলাদেশি কয়েকটি চিহ্নিত গণমাধ্যমে নিজেদের বিবৃতি পাঠিয়েছেন। এতে স্পষ্ট, তারা বিকল্প রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছেন কোনো একটি পক্ষের হয়ে। আর বিএনপির সাম্প্রতিক বক্তব্যতে তা সুষ্পষ্ট। বিএনপি নেতাদের বক্তব্য এবং বিদেশি লেজুড় গোষ্ঠীর বক্তব্য একইসুরে গাঁথা। যেন একটি অভিন্ন স্ক্রিপ্ট পড়ছেন সবাই মিলে। বিএনপির সাথে বৈঠকের পরই একে একে এই খেলাগুলো খেলা হচ্ছে।

সমীকরণটি পরিস্কার। বিএনপি নিজেদের ঘাড়ে নিতে চাইছে না কিছুই। নিজেরা পদযাত্রার নামে চালাচ্ছে সহিংসতা। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে বিএনপির সন্ত্রাসীরা। আর এসব ঘটনা ধামাচাপা দিতে তারা বেছে নিয়েছে গুজব ও মিথ্যাচার। তার গুটি বানানো হয়েছে ডিশ আলমকে। একদিকে ডিশ আলম ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করা হচ্ছে, বিদেশিদের দিয়ে বিবৃতি দেয়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে নিজেদের অপকর্ম থেকে সবার দৃষ্টি সরানো যাচ্ছে।

যে তারেক রহমান বিএনপিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তিনি লেজগুটিয়ে বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে ডিশ আলমকে দিয়ে বৈতরণী পার হতে চাচ্ছেন। প্রয়োজনে নাক তথা তারেককে কেটে হলেও আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা থামানো জরুরি হয়ে গেছে এখন বিএনপির জন্য। বিএনপির রাজনীতিতে তারেকের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার, তা নেতাকর্মীরাও বুঝে গেছে। তাই মাঠ থেকে আওয়ামী লীগকে সরাতে, বিদেশিদের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানাতে ডিশ আলমই বিএনপির শেষ অস্ত্র।

আরও পড়ুনঃ

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে