শাপলা চত্বর তাণ্ডবে হেফাজতের পেছনে বিশাল বিনিয়োগ ছিল বিএনপির, আদিলুর সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ

0
470
শাপলা চত্বর

শাহবাগ আন্দোলন শুরুর আগে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ সাজার দাবি উঠছিল সারাদেশে। যুদ্ধাপরাধের ঘটনাগুলো প্রকাশিত হতে লাগল পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়। তখন বিএনপি উঠেপড়ে লাগে জামায়াতকে রক্ষায়, জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে। ফলে সাধারণ মানুষের চোখে জামায়াতের মত বিএনপিও চক্ষুশূল হয়ে যায়। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে, জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টিসহ মানবাধিকারের নামে বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা ভাড়াটে সংগঠনগুলো বিএনপি-জামায়াতের সাথে চুক্তিবদ্ধ লবিস্ট ফার্মগুলোর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে বিবৃতি দিতে শুরু করে। তখন বিএনপি নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে মার্কিন বন্ধুদের পরামর্শে ও ইন্ধনে অন্য মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে ব্যবহারের চেষ্টা চালায়। গোপনে তাদের সব ধরনের সহায়তাও দেয়া শুরু করে বিএনপি।

এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সাথে কয়েকদফা বৈঠক হয় হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, মামুনুল হকসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দের। রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর পুত্র মাসুদ সাঈদী ও বাবুনগরীর সেই গোপন বৈঠকের ছবি ফাঁস হয়ে যায়, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত আরেক বৈঠকে বিএনপির সাথে বাবুনগরীর এক চুক্তি হয়। যা সেসময় আহমদ শফী জানতেন না। শফী জামায়াতবিরোধী বলে চুক্তির কথা তাকে জানানো হয়নি।

হেফাজতের যে বিপুল সংখ্যক কর্মী রয়েছে, তাদেরকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই বাবুনগরীর দ্বারস্থ হয় বিএনপি-জামায়াত। বাবুনগরী উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তাদের ঢাকা দখলের কাজে ব্যবহার করবেন, এটাই ছিল পরিকল্পনা। বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে সরকার উৎখাতের কাজে হেফাজত কর্মীরা কাজ করবে- এতে আহমদ শফী রাজি হবেন না, এই শঙ্কা থেকেই সংগঠনে বড় ধরনের বিভাজন তৈরি করা হয়। ৫ই মে আহমদ শফী নিজেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানতেন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন না বলে ধারণা করা হয়।

খেলাফত মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা, পাকিস্থানপন্থী স্বাধীনতাবিরোধী ও আফগানফেরত জঙ্গি নেতা আজিজুল হকের পুত্র উগ্রপন্থী মামুনুল হক একইসাথে খেলাফত এবং হেফাজত- উভয় সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মামুনুল এবং তার উস্তাদ বাবুনগরীকে টোপ দেয়া হয়। সরকারের পতন ঘটাতে পারলে তাদেরকে নতুন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসানো হবে। বাবুনগরী রাষ্ট্রপতি, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী, মামুনুল হক এবং বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, খেলাফতসহ অপর মৌলবাদী সংগঠনগুলোর নেতাদের মন্ত্রী করা হবে, এমন আশ্বাস দেয়া হয়।

শর্ত ছিল হেফাজত তাদের হাজার হাজার কর্মী নিয়ে সারাদেশ থেকে ঢাকায় জড়ো হয়ে শহর অচল করে দেবে। জ্বালাও-পোড়াও ও তাণ্ডব চালিয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে, যেন কেউ বাধা দিতে না পারে। আল-জাজিরা, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের মত হলুদ মিডিয়া এবং ভাড়াটে মানবাধিকারবারীরা পাশে থাকবে; যেন পুলিশ-র‌্যাব অ্যাকশনে গেলে তা ফলাও করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরে দাবি করবে, সরকার সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর্ দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।

এরইমধ্যে হেফাজত কর্মীরা গণভবনে আক্রমণ চালিয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করবে, এরপর বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। এই ভয়ানক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিএনপি-জামায়াত সেসময় ১০ কোটি টাকা দেয় হেফাজতে ইসলামকে, যা পরে ফাঁস হয়। সেই আর্থিক লেনদেনে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, হাবিবুন নবী সোহেল, জামায়াত নেতা মাসুদ সাঈদীসহ আরও কয়েকজন। হেফাজতের পক্ষে সেই অর্থ গ্রহণ করেন স্বয়ং জুনায়েদ বাবুনগরী।

[শাপলা চত্বর তাণ্ডবে হেফাজতের পেছনে বিশাল বিনিয়োগ ছিল বিএনপির, আদিলুর সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ]

হেফাজত যখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়ে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিল, তখন বিএনপি নেতারা দলবেঁধে হেফাজতের কাছে যায়। আহমদ শফীকে কদমবুসি করে। হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির সখ্যতা এতই গভীর হয়েছিল যে, খোদ খালেদা জিয়া হেফাজত নেতাদের ঢাকায় মেহমান আখ্যা দিয়ে তাদের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। সেখানে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বক্তব্য রেখেছিলেন।

৫ই মে হেফাজত কর্মীদের শাপলা চত্বরের সেই ভয়ানক তাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ, সড়ক অবরোধ, ভাঙচুর, লুটপাট, হামলা সত্ত্বেও সরকারের অনড় অবস্থান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় সকল অপচেষ্টা ভেস্তে যায়। লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয় নাশকতাকারীরা। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন কয়েকজন হেফাজত কর্মী। ক্যু প্রচেষ্টায় ব্যর্থতার পর হলুদ মিডিয়া গুজব ছড়ায় হাজার হাজার হেফাজত কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে বলে। হেফাজতকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলতে হলুদ মিডিয়া এই কাজটি করে।

এ ঘটনায় আহমদ শফী ক্ষুব্ধ হন। সরকারের ওপর চাপ আসতে থাকে। সরকারের বিভিন্ন মহল তদন্তে নেমে দেখতে পায় বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের দেয়া হাজার হাজার মৃত্যুর ঘটনা পুরোটাই ভুয়া। সেসময় বিএনপি সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর রহমানের ধান্দাবাজ সংগঠন অধিকার-এর পক্ষ থেকে নানারকম গুজব ছড়ানো হয়। যার পেছনে ছিল মার্কিন কয়েকটি সংস্থা। পুলিশ যখন হেফাজতকে ঢাকা থেকে বের করে দিচ্ছিল, তখন বিএনপি তার প্রতিবাদ করে সেখানে হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলেও দাবি করে। এসবই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত।

২০১৩ সালের ১০ই জুন অধিকার শাপলা চত্বরের ৫ ও ৬ই মে’র ঘটনা নিয়ে ফ্যাক্টস এন্ড ফাইন্ডিং রিপোর্ট তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। দাবি করা হয়, উক্ত সংঘর্ষে হেফাজতের ৬১ জন কর্মী নিহত হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সেই তালিকা অনুসারে তদন্তে নামে। প্রাথমিক তদন্তে অধিকার-এর রিপোর্টে অনেক গুরুতর অসঙ্গতি দেখা যায়, যেমন- ৫ ব্যক্তির নাম একাধিকবার, ১১টি ভুয়া নাম, শারীরিক অসুস্থতায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারীর নাম ছাড়াও ঢাকার বাইরে মৃত্যুবরণ করা ৬ জনের নামও সেই গোঁজামিলপূর্ণ তালিকায় রয়েছে।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর উদ্ভূত বিভ্রান্তি দূর করতে তথ্য মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের ১০ই জুলাই তথ্য অধিকার আইনের অধীনে অধিকার-এর নিকট তালিকার বিস্তারিত তথ্য ও প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের নির্দেশ দিলে অধিকার তা সরবরাহে অনীহা জানায়। এছাড়া এনজিও ব্যুরোকেও তারা গোপনীয়তার অজুহাতে সেই প্রতিবেদনের মূল তথ্য পাঠায়নি। ফলে ২০১৩ সালের ১০ই আগস্ট আদিলুর ও অধিকার-এর পরিচালক নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর দায়ে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা হয় (মামলা নং-০১/২০১৩)।

আদিলুরের সেই গোঁজামিল রিপোর্ট উদ্ধৃত করে আল-জাজিরা, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারও গুজব ছড়াতে থাকে। এদিকে বেসরকারি টিভি চ্যানেল একাত্তর নিজস্ব সোর্স নিয়ে তদন্তে নেমে দেখে যাদের মৃত দাবি করা হচ্ছিল, তারা সবাই জীবিত। একাত্তর টিভি তালিকা ধরে সেই মৃতদের একে একে হাজির করলে ধরা পড়ে বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত, আদিলুর, অধিকার, আল-জাজিরা, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্র।

হেফাজতে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, কর্মীদের আস্থা চলে যাবে মুরুব্বিদের ওপর থেকে, সংগঠনে ভাঙন ধরবে- এসব বিবেচনায় তখন কেউ মুখ খুলতে না চাইলেও দ্বন্দ্বের শুরু হয়ে যায় শফীপন্থী ও বাবুনগরীপন্থীদের মাঝে। জামায়াতপন্থী বাবুনগরীর বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায় সরকারবিরোধী চক্রান্তে জড়িত থাকায়। বাবুনগরী যে জামায়াতের পক্ষে কাজ করছেন, তা আহমদ শফীর পুত্র আনাস মাদানী ফাঁস করে দেন ফেসবুক লাইভে। যা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বাবুনগরীর খাদেম রাকিবুল ইসলাম ফারুকীর কাছে থেকে গোপনে অনেক তথ্য পেয়ে লাইভে বাবুনগরী জামায়াতের এজেন্ট বলে পরিচয় ফাঁস করেন আনাস মাদানী।

তার ফোনালাপও ফাঁস হয় সেসময় (www.facebook.com/100064636753716/videos/728140844427755/)। তাতে উল্লেখ করেন তিনি ৫ই মে শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের উস্কানি দিয়ে নিয়ে গিয়ে উল্টো মার খাইয়েছেন বাবুনগরী। তিনি জামায়াতের পক্ষে কাজ করছেন সবসময়, এমন তথ্য দেন। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নিরীক্ষক মাওলানা সলিমুল্লাহ ২০২১ সালে এক সভায় বাবুনগরীর আর্থিক অনিয়মের তথ্য ফাঁস করে দেন (www.facebook.com/arman.ctg.39/videos/2865997610281790/)।

সাদেক হোসেন খোকার হাত থেকে নেয়া ৫০ লক্ষ টাকা, চিকিৎসা নামে নেয়া ২০ লক্ষ টাকাসহ নানাসময় আর্থিক হিসাব দাখিলের জন্য বারবার তাগাদা দিলেও ২০১৩ সাল থেকে আমৃত্যু সেই হিসাব দেননি বাবুনগরী। এসব অর্থ বাবুনগরী পেয়েছেন হেফাজতকে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে রাস্তায় নামানোর জন্য।

[শাপলা চত্বর তাণ্ডবে হেফাজতের পেছনে বিশাল বিনিয়োগ ছিল বিএনপির, আদিলুর সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ]

জামায়াতের সাথে বাবুনগরীর সম্পৃক্ততার তথ্য ফাঁসের পর আনাস মাদানী ও শফীপন্থীদের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির সহিংস হয়ে ওঠে। গুজব-অপপ্রচার চালিয়ে উস্কে দেয়া হয় হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের। ক্ষমতালোভী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হেফাজত নেতাদের নিজেদের পক্ষে এনে শফীপন্থীদের কোণঠাসা করা হলে মাদ্রাসায় শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

এটা জানা কথা, হাটহাজারী মাদ্রাসার দখল নিতে পারলে দেশের হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এ লক্ষ্যে মাদ্রাসায় জামায়াত-শিবিরের চরেরা অনুপ্রবেশ করে। তারা আহমদ শফীকে অবরুদ্ধ করে তার চিকিৎসায় বাধা দেয়। পরে হাসপাতালে নেয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্সও আটকে রাখে কয়েক ঘণ্টা। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া পেলেও হাসপাতালে শায়িত আহমদ শফীর অক্সিজেন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন মামুনুল হক। এভাবে আহমদ শফীর মৃত্যু ঘটে।

হেফাজতকে আহমদ শফী অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও বাবুনগরীরা একে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। মূলত এ কারণেই উভয়পক্ষের মাঝে বিরোধের সৃষ্টি হয়। শফীপন্থীদের মাঝে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে আকাঙ্ক্ষা অতীতে দেখা যায়নি। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাগুলোর লাখো শিক্ষার্থী এবং হাজারো শিক্ষক ও আলেমদের নিজেদের নষ্ট রাজনীতির পথে এনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে একটা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ সৃষ্টিতে বিএনপি ও জামায়াত সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করে। এই পুরো পরিকল্পনার পেছনে মার্কিন অপশক্তির হাত রয়েছে। আদিলুর ইস্যুর পর মার্কিন দূতাবাসের অবস্থানে তা স্পষ্ট হয়।

জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন পক্ষের কাছ থেকে বাবুনগরীর কাছে বিপুল অর্থ আসত দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটানোর জন্য। টিআইবি, অ্যামনেস্টি ছাড়াও মার্কিন অর্থায়নে লালিত পালিত অধিকার, আসক, ব্লাস্টসহ বেশকিছু সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত। এখনও তাদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে বিপুল অর্থ আসে দেশে আবারও জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে। এর কিছু নমুনা দেখা যায় বাবুনগরীর মৃত্যুর পর। তার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল অর্থ-সম্পদের হদিস পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

জঙ্গিবাদে অর্থায়নে বিদেশি অপশক্তিগুলো ব্যবহার করত বাবুনগরৰী ও তার চ্যানেলকে। তার মাধ্যমে মাদ্রাসা, এতিমখানা ও হেফাজতের কর্মীদের চিকিৎসার নামে দেশ বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা অনুদান আসত। এভাবে আসা অর্থ নিয়ে কেউ সন্দেহ করত না। তবে এই বিপুল অর্থ মাদ্রাসার অ্যাকাউন্টে না রেখে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রাখতেন বাবুনগরী। কিন্তু সেসব অর্থ ব্যয়ের কোনো হিসাব নাই তার কাছে। জঙ্গিবাদ ও নাশকতার কাজে খরচ করা হতো এই অর্থ। আহমদ শফীর শ্যালক মাওলানা মঈনউদ্দিন রুহী জানান, মাদ্রাসার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বাইরে আসা অর্থের বেশিরভাগই জমা থাকত আলমিরায়। আহমদ শফীর ওপর হামলা করে মাদ্রাসার দখল নেয়া এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে আলমিরায় থাকা কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়। বাবুনগরী ও তার অনুসারীরা এই অর্থ সরিয়েছেন বলে জানান তিনি।

[শাপলা চত্বর তাণ্ডবে হেফাজতের পেছনে বিশাল বিনিয়োগ ছিল বিএনপির, আদিলুর সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ]

জুনায়েদ বাবুনগরীর জীবদ্দশাতেই তার অর্থবিত্তের উৎস অনুসন্ধানে নেমেছিল গোয়েন্দা সংস্থা। তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে সেসময় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বাবুনগরী রীতিমত টাকার পাহাড়ে বসে আছেন। মাদ্রাসা শিক্ষক হয়ে কীভাবে তিনি এত বিত্তবান হলেন সেই প্রশ্ন সন্দেহ জাগায়। তখন বাবুনগরীসহ হেফাজতের ৪৬ নেতার সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারি ৪টি দপ্তরকে চিঠি দেয় দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নেত্রকোনা পুলিশ সুপার, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও পটিয়া থানার সহকারী কমিশনার ভূমি ও ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সহকারী ভূমি ও ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারকে পাঠানো চিঠিতে হেফাজত নেতাদের পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জমির দাগ, খতিয়ান, নথি চাওয়া হয়। আর বিএফআইইউ-এর প্রধানকে পাঠানো চিঠিতে এই নেতাদের ব্যাংক হিসেবও পাওয়া গেছে।

গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধানে জুনায়েদ বাবুনগরীর ১২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পায়। তাতে (ওই সময় পর্যন্ত) প্রায় ৪৪ কোটি টাকার হিসেব মিলেছিল। যা জঙ্গিবাদ ও নাশকতার অর্থায়ন বলে ধারণা হলে বাবুনগরীর ঘনিষ্ঠরা দাবি করেন, এসব দান-খয়রাতের টাকা। কিন্তু দান-খয়রাতের টাকা কেন মাদ্রাসার অ্যাকাউন্টে না এসে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে এসেছে- এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি তারা। অনুসন্ধানে দেখা যায়,
বাবুনগরীর নিজের নামে গাজীপুরে জমি রয়েছে, নারায়ণগঞ্জে একটি কারখানার জমি রয়েছে, নেত্রকোনায় স্ত্রীর নামে জমি রয়েছে। এছাড়া নিজ নামে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জমিসহ দালান রয়েছে। হাটহাজারীতে তার একাধিক বাড়ি এবং পটিয়াতেও বিশাল জমি রয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত এসব অর্থের সব হিসাব বাবুনগরীর কাছে থাকত। এসবের উৎস বা ব্যয়ের হিসাব অজানা।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে বাবুনগরীর প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার সম্পত্তির হদিস মিলেছে। সেসময় তদন্তকারীরা জানান, এ ব্যাপারে দুদকের অনুসন্ধান এবং যাচাই-বাছাই শেষে বোঝা যাবে আসলে তার কত সম্পদ রয়েছে। বিদেশ থেকে আসা বিপুল অর্থের গন্তব্য ছিলেন বাবুনগরী। তার হাত দিয়েই রাজনৈতিক নাশকতা ও জঙ্গিবাদে এসব অর্থ ব্যয় হতো। বিগত কয়েক বছরে নতুন সৃষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর পেছনে সিআইএ পরিচালিত বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত এই অর্থ সম্পৃক্ত বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে সারাদেশে চালানো তাণ্ডবেও ব্যয় হয়েছে এসব অর্থ।

উল্লেখ্য, শিক্ষা জীবনে হাটহাজারী মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার্থে ১৯৭৬ সালে জুনায়েদ বাবুনগরী পাকিস্থানের করাচিতে অবস্থিত তালেবানি মতাদর্শে পরিচালিত দারুল উলুম ইসলামিয়াতে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তার মাঝে উগ্রপন্থার বীজ বপন হয়। যার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে তার রাজনৈতিক জীবনেও। হেফাজতে ইসলামকে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচালিত করতেন প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শফী। কিন্তু বাবুনগরী একে উগ্র মতাদর্শে টেনে নিয়ে গেছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে তিনি মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে বিএনপি-জামায়াতের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

বিএনপি-জামায়ত সবসময় হেফাজতে ইসলামকে আওয়ামী লীগের ঘুঁটি আখ্যা দিয়ে নানারকম অপপ্রচার চালিয়েছে মূলত নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে। অথচ হেফাজত ২০১৩ সাল থেকে তাদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে আসছে। জুনায়েদ বাবুনগরী যখন হেফাজতের আমির হলেন তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তাকে অভিনন্দন জানান। তাহলে বিএনপি কোন মুখে এই গভীর সম্পর্ককে অস্বীকার করবে?

হেফাজত যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধিতা করল তখন কেন হেফাজতের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল বিএনপির নেতৃবৃন্দ? হেফাজত যখন সারাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাণ্ডব চালাচ্ছিল এবং নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঠেকাতে রুখে দাঁড়ালো, ঠিক সেসময় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সব কর্মসূচি থেকে বিএনপি সরে এলো! নিজেদেরকে সব অপকর্ম থেকে আড়াল করতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি? কাজেই বিএনপি-জামায়াত যতই হেফাজতের সাথে তাদের সম্পর্ক নাই দাবি করুক না কেন, বাস্তবতা হলো তাদের মধ্যে প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক সবসময় আছে। একইসাথে জড়িত আছে মার্কিন অপশক্তি এবং তাদের লেজুড় বাংলাদেশি আদিলুররা।

আরও পড়ুনঃ

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে