ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা। আওয়ামী লীগের হয়েও করেছেন রাজনীতি। আওয়ামী লীগের টিকেটে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে ভালোবাসতেন, তাকে টেনে তুলে এনে আইনমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি কতটুকু বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিলেন তা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে, অনেক ধরণের প্রশ্ন রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তথ্য অনুসন্ধানে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যা বঙ্গবন্ধু হত্যা রহস্যের নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এর মাধ্যমে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নতুন করে আতশ কাঁচের নিচে ফেলা হচ্ছে।
ড. কামাল হোসেন কি আসলেই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী নাকি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছিলেন? তিনি কি আসলে একজন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক নাকি ষড়যন্ত্রকারী? এই প্রশ্ন যৌক্তিকভাবেই উঠেছে।
এই প্রশ্ন অবশ্য অনেক পুরনো। কারণ ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন শহিদ হন, তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা এবং ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানীতে। এই সময়ে ড. কামাল হোসেন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন; বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় তার ভূমিকা ছিল রহস্যময়।
আরো পড়ুনঃ ক্ষমতা দখলের জন্য বেপরোয়া ড. কামাল, চার স্তরের আগ্রাসী পরিকল্পনা
শেখ রেহানা সেসময় ড. কামাল হোসেনকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য এবং আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করার জন্য আকুলভাবে আবেদন করেছিলেন, কিন্তু ড. কামাল হোসেন সেই আবেদনে সাড়া দেননি। ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর থেকে জিয়াউর রহমানের শাসনামল এবং পরবর্তীতে কখনই ড. কামালকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ব্যাপারে সোচ্চার দেখা যায়নি।
বরং এই ব্যাপারে তিনি রহস্যময় ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে যখন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে করেছিল, তখনও ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা ছিল খুবই রহস্যময়।
আরো পড়ুনঃ মোশতাক ষড়যন্ত্র করতে পারে- এটা আব্বা জানতেন: শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ
বছরখানেক আগে ড. কামাল হোসেনের একটি পুরনো ছবি নতুন করে বেরিয়ে আসে। যেই ছবিটি ১৯৯০ সালে তোলা। যে সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছে, তখন সেই সময়ে ঢাকায় অবস্থিত শ্রীলঙ্কান দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনকে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপচারিতায় দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, এর আগেই আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর ১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনিদের সামাজিকভাবে বয়কট ও তাদের কোনো অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই প্রকাশ্যে এবং গোপনে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যেত। বিষয়টি কানে যায় এমনকি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনারও। এতে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান দলীয় সভায়।
আরো পড়ুনঃ কেন জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কোনো বায়োপিক করতে পারেনা বিএনপি
ড. কামালের সেই ছবিটি দেখে বোঝা যায়, তার সঙ্গে বজলুল হুদার দীর্ঘ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এই একটি ছবিই অনেক কথা বলে দেয়। তাহলে কি ড. কামাল হোসেন ৭৫-এর খুনিদের মদদ দিয়েছিলেন? এদের প্রতি কেন তার কোনো ঘৃণার উদ্রেক হয়নি? এদের সঙ্গে তার কোনো যোগসাজশ ছিল কি না, এমন বহু প্রশ্নের পথ উন্মুক্ত করে দেয় ছবিটি।
যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের উদ্যোগ নেয়, তখন ড. কামাল হোসেন ছিলেন নীরব। তিনি যদি বঙ্গবন্ধুকে এতই ভালোবাসতেন, তাহলে তিনি এই ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি কেন? এই ব্যাপারে তিনি কোনো অবস্থান নেননি কেন?
এমনকি যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের নেতৃত্বে, তখনও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ছিলেন ভূমিকাহীন।
আরো পড়ুনঃ বঙ্গবন্ধু হত্যা: জিয়াউর রহমানের টেনিস-কোর্ট ষড়যন্ত্র
তাই প্রশ্ন উঠেছে, ড. কামাল হোসেন আসলে কার পক্ষের লোক ছিলেন? ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার ভূমিকা নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আক্ষেপ করেছেন তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে। খন্দকার মোশতাকের মত আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা অনেক ছদ্মবেশি বিদেশি এজেন্ট ১৫ই আগস্টের সাথে জড়িত ছিল।
আর তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইতিহাস গবেষকরা বলেন, ৭৫-এর ট্র্যাজেডির পেছনে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে আরো বেশি গবেষণা হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা দরকার বলে মনে করেন তারা।
কেন ড. কামাল হোসেন-কে নিয়ে ইতিহাস গবেষকরা সন্দেহ পোষণ করেন, দেখা যাক।
১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ রাতে ক্র্যাকডাউনের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়িতে বৈঠক হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু নির্দেশনা ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থের ১৯ ভলিউমে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন ২৫শে মার্চ রাতে গাড়িতে করে নিয়ে পশ্চিম বাংলার উদ্দেশে কুষ্টিয়ার পথে ঢাকা থেকে রওনা হন।
যাত্রা শুরুর পরপরই ড. কামাল তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে গাড়ি থেকে নেমে যান এই বলে, তিনি শীঘ্রই ফিরে আসবেন। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন এরপর গাড়িতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু ড. কামাল আর ফেরেননি। অবশেষে তারা দু’জনই কুষ্টিয়ার পথে এগুতে থাকেন। এরপর পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ড. কামাল হোসেনের আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের পর অবশ্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই বিমানে পাকিস্থান থেকে ফিরে এলে জানা যায়, তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে শ্বশুরবাড়ি পাকিস্থানেই ছিলেন।
তিনি কীভাবে সেখানে গেলেন, কোথায় ছিলেন- এ প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া যায় পাকিস্থান স্পেশাল সার্ভিসের (আইএসআই) যাকে স্থপতি বলা হয়, সেই মেজর জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠ্ঠার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আনলাইকলি বিগিনিংস’-বইটিতে। মিঠ্ঠা লিখেছেন, ড. কামাল হোসেনকে তিনিই পাকিস্থানে নিরাপদে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কেন ড. কামাল হোসেনকে সাথে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন- এটি সবারই প্রশ্ন। এটি ছিল ভুট্টোর এক কৌটিল্য পদ্ধতির ষড়যন্ত্রের সফল ফসল। ভুট্টো ভেবেছিলেন তাদের জামাতা ও নিজস্ব লোক বলে বিবেচিত ড. কামালকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই বিমানে পাঠাতে পারলে পাকিস্থান লাভবান হবে। তাই তার এই ষড়যন্ত্র।
বঙ্গবন্ধু সবে মুক্তি পেয়েছেন। বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটির মহানুভবতা ছিল আকাশচুম্বী। তিনি কাউকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করতে পারতেন না। তাই ভুট্টোর ষড়যন্ত্রও তিনি আঁচ করতে পারেননি। যেমন পারেননি মোশতাক-জিয়া, তাহের ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম, মাহবুবুল আলম চাষীদের ষড়যন্ত্র, যেমন পারেননি ডালিমের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে, যে ডালিমকে তিনি ঘরের ছেলের মতই স্নেহ করতেন।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা কী ছিল?
বঙ্গবন্ধুর অতি ঘনিষ্ঠজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ফরাসউদ্দিন এ নিয়ে যথার্থই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় ড. কামালের হাত ছিল কি না এটা খতিয়ে দেখা উচিত।
১৫ই আগস্টের পরপরই যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের সভা আহ্বান করা হয়। যেখানে ছিলেন যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক আবুল হাসেম, সাধারণ সম্পাদক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ড. আবদুল গাফ্ফার চৌধুর প্রমুখ।
সবাই মিলে বহুবার ড. কামাল হোসেনকে অনুরোধ করার পরেও তিনি সেই সভায় যোগ দেননি। তিনি তখন অক্সফোর্ডে থাকতেন (বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুমতি নিয়ে মন্ত্রীত্ব থাকা অবস্থাতেই ড. কামাল সংবিধান বিষয়ে স্টাডি করছিলেন বলে দাবি করা হয়)। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অবশ্য সেই সভায় এসেছিলেন।
এরপর বিশ্বখ্যাত আইরিশ মানবতাবাদী নোবেল লরিয়েট শ্যেন ম্যাকব্রাইটের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হলে ড. কামাল হোসেন সেই তদন্ত কমিশনে থাকার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।
পরবর্তীতে শ্যেন ম্যাকব্রাইটের নেতৃত্বে সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়, যে পরিষদে ছিলেন- বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, মাইকেল বার্নস, সর্বজনাব ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকী, সৈয়দ আশরাফ, ডা. সেলিম, ডা. জায়েদুল হাসান, অ্যাকাউনটেন্ট রউফ প্রমুখ। কিন্তু ড. কামাল ঐ পরিষদে যোগ দেয়ার প্রস্তাবও নাকচ করেছিলেন।
এসব প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে ড. কামাল হোসেনের রহস্যময় ভূমিকা সম্পর্কে অনেকটা আঁচ করা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যাকে ‘বিগ আংকেল’ বলে সম্বোধন করতেন, বারংবার ভুল করেও বঙ্গবন্ধুর স্নেহের আতিশয্যে রক্ষা পেয়েছেন, সেই রহস্যময় ড. কামালের সাথে পাকিস্থানি জেনারেল এবং বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সাথে সম্পর্ক নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়।
সূত্র: বিচারপতি (অব.) শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এর সাক্ষাৎকার।
আরো পড়ুনঃ