বানরের মত ডিগবাজি দিয়ে আবারও জামায়াতের কোলে অলি, নয়া ষড়যন্ত্র শুরু

0
542
জামায়াত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বর্ণিল চরিত্র বিএনপির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তীতে সেই দলের প্রধান দুই ব্যক্তিকে গালাগাল করে দলত্যাগী হয়ে এলডিপি নামক নতুন রাজনৈতিক সংগঠন খোলা কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। বর্ণিল চরিত্র এ কারণে যে, বানরের মত ডিগবাজি খেয়ে সব দলে পরিভ্রমণকারী হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ; তবে অলি নিজেও কম যান না। তিনি হয়ত মওদুদের মত অত বেশি দল বদলের ডিগবাজি দেননি, তবে তিনি পক্ষ বদল, জোট-উপজোট-মঞ্চ সৃষ্টি এবং মতাদর্শ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অনন্য রেকর্ডধারী হবেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অলি আহমেদ-এর গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র কারণ হলো তার অতীত। তিনি একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, শুধু এই পরিচয়টুকু তাকে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। সেই পরিচয় বিক্রি করে চলছেন তিনি আজ অব্দি। তবে অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ যেমন বলেছিলেন, “একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার, কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়।” প্রবচনটা অলি আহমেদ-এর ক্ষেত্রে ১৬ আনাই সত্য। তিনি রাজনৈতিক পক্ষ বদল করতে করতে বিএনপিকে যেমন ‘রাজাকারনির্ভর’ দল বলে তিরস্কার করেছেন, তেমনি রাজাকারদের সাথে জোটও বেঁধেছেন।

এই প্রতিবেদনে আমরা দেখব একজন রাজনীতিবিদের অধঃপতন।

অলি আহমেদ ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এর আগে ‘৯১-তে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী হন। ১৯৯৬’র ১৫ই ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে বিএনপি আবার সরকার গঠন করলে তিনি প্রথমে কৃষি, খাদ্য ও পানিসম্পদমন্ত্রী এবং পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রীর দপ্তর পান। যদিও সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পুনঃ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় তার মন্ত্রীত্ব ঘুচে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৪ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে চারদলীয় জোটের মনোনয়ন নিয়ে অলির সঙ্গে জামায়াতের তীব্র মতভেদ সৃষ্টি হয়। মূলত জামায়াতবিরোধী হিসেবে তার অবস্থান ছিল তখন। যদিও তার দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন জামায়াতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং রাজাকারদের পুনর্বাসনকারী। যাই হোক, সেসময় জামায়াতকে কেন্দ্র করে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে তার একটা বিরোধ সৃষ্টি হয়।

তারপরও তিনি চট্টগ্রাম-১৩ ও ১৪ আসনে নির্বাচনে প্রার্থী হন। চট্টগ্রাম-১৩ আসনে জয়লাভ করলেও জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত চট্টগ্রাম-১৪ আসনে জামায়াত প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর কাছে হেরে যান অলি। এরপর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি জোট বেঁধে সরকার গঠন করলেও অলি মন্ত্রীত্ব পাননি সেই বিরোধের জেরে এবং শাহজাহান চৌধুরীর চাপে। বিএনপি সরকার দলের সিনিয়র নেতা অলিকে শেষ পর্যন্ত সাইডলাইনে বসিয়ে রাখে। জামায়াতের কাছে এভাবে পর্যুদস্ত হয়ে অপমানে-ক্ষোভে অলি দলের হাইকমান্ডের সাথে প্রকাশ্যে বিরোধিতায় নামেন। সরকারের মেয়াদের শেষলগ্নে অর্থাৎ ২০০৬ সালের ২৬শে অক্টোবর অলি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। অলির আগে লাঞ্ছিত হয়ে দলত্যাগ করেছিলেন বিএনপির আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বি. চৌধুরী এরপর বিকল্পধারা গঠন করেন। অলি বেরিয়ে এসে তাকে সাথে নিয়ে গঠন করেন এলডিপি।

নতুন দল গঠনের আগে ও পরবর্তী সময় অলি আহমেদ বিএনপি ও এর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অনেক তির্যক মন্তব্য করে রাজনীতির মাঠ গরম করে নিজের দলের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তার সেসময়কার কিছু বক্তব্য নিম্নরূপ।

বিএনপি, খালেদা, তারেক ও নেতাদের নিয়ে অলি আহমেদের কিছু মন্তব্য:

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে অলি বলেছিলেন, ‘চার বছরে যারা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, তাদের আগে কিছুই ছিল না। তারা এখন গাড়িও কিনেছে। যারা হাফশার্ট পরত এখন তারা ফুলশার্ট পরে। যারা স্যান্ডেল পরত, তারা এখন ইতালিয়ান শ্যু পরে। যাদের ঘুমানোর জায়গা ছিল না, তারা গুলশানে বাড়ি করে গাড়ি হাঁকায়।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জিয়াকে রাস্তা থেকে ডেকে এনে যুদ্ধে নামিয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করিয়েছি। যেসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জুতা স্যান্ডেল টানে, তারাই কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে আমার বিরুদ্ধে কথা বলছে। কয়েকজন সারারাত মদ খেয়ে বদমায়েশী করে মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। ১৫/২০ জন মন্ত্রীর একটি সিন্ডিকেট বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ঘুষ খায়। ঘুষ খেয়ে একেকজন ১০/১২টি বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির মালিক।’

চট্টগ্রামের এক প্রতিমন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে অলি বলেছিলেন, ‘যার ২ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দেয়ার ক্ষমতা ছিল না, তিনি কাস্টমসের পিয়ন-কেরানির সঙ্গে আঁতাত করে এখন শত কোটি টাকার মালিক। চতুর্থ শ্রেণীরও নেতা নন এমন একজন হয়েছেন ব্যাংক ও মিডিয়ার মালিক। এরা সকলেই খালেদা জিয়ার জুতা স্যান্ডেল খুঁজে দেন।’

২০০৬ সালের ২২শে নভেম্বর চট্টগ্রামের মুসলিম হলে এলডিপিতে যোগদানের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অলি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ উত্থানের জন্য খালেদা ও তার পুত্র তারেক দায়ী। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত-শিবির আশ্রিত ক্যাডাররা সারাদেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলার সাহস পেয়েছে। দুই ‘হা’- অর্থাৎ হাওয়া ভবন ও হারিছ চৌধুরীর কারণে খালেদা জিয়া একদিন হাওয়া হয়ে যাবেন।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বিএনপির জন্মের পর মুসলিম লীগের মৃত্যু হয়েছে। এলডিপির জন্মের কারণে বিএনপির মৃত্যু হবে।’

খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানকে নিয়ে তার একটি মন্তব্য বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অলি বলেছিলেন, ‘মা ভাল হলে ছেলে খারাপ হবে কেন।’

সেই অলি আহমেদই আবার নিজ এলাকায় জামায়াতের প্রভাবের কারণে তাদের সাথে বিরোধিতার বিষয়টি সম্পর্কে সযত্নে এড়িয়ে যান। বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার পেছনে কারণ দেখিয়েছেন চারদলীয় জোট সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিভিন্ন বিষয়। তবুও তার রাজনৈতিক অভীপ্সা দেখে মতাদর্শগত দূরত্ব তৈরি হয় বি. চৌধুরীর সাথে। ফলশ্রুতিতে দুজনের পথ দুদিকে যায় বেঁকে। ভাঙে বিকল্পধারা-এলডিপি জোট।

জাতীয় ঐক্যের নামে আওয়ামী লীগের সাথে ঘেঁষার চেষ্টা এবং আরেক ডিগবাজি:

অলি আহমেদ বিএনপিতে থাকাকালে জামায়াত নিয়ে তার আপত্তির কথা প্রকাশ্যেই বলতেন। স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় আপত্তি জানিয়েই তিনি বিএনপি ছেড়েছিলেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে যোগ দেন। পরে ২০০৭ সালের নির্বাচন বাতিলের পর এই জোট আর টেকেনি। আর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনে মহাজোট অলি আহমেদকে আর নেয়নি। আর এক পর্যায়ে ‘জামায়াতে আপত্তি’ ভুলে আবার বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলে যোগ দেন অলি আহমেদ।

এখানে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে একই আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও। বিএনপির আহ্বানের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাফ জানিয়ে দেয়, স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতকে সঙ্গে রেখে কোনো ঐক্য সম্ভব নয়। এরপর আভাসে-ইঙ্গিতে প্রয়োজনে জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ত্যাগের কথা জানান বিএনপি নেতারাও।

সেসময় গণমাধ্যমকর্মীরা অলি আহমেদের কাছে জানতে চান, জামায়াতকে জোটে রেখে জাতীয় ঐক্য সম্ভব কি না। জবাবে সরাসরি কিছু না বলে অনেকটা ঘুরপথে জবাব দিয়ে বলেন, ‘এ ব্যাপারে (জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল বিষয়ে) হাইকোর্টের আদেশ রয়েছে। তাই এ নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই্ না।’

অলি আহমেদ ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে চট্টগ্রামে অবাঞ্চিত ঘোষণা:

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচারের দায়ে ২০১২ সালে অলি আহমেদ এবং জামায়াতের লেজুড় খ্যাত কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে চট্টগ্রামে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামে একটি সংগঠন। চট্টগ্রামে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ দাবিকারী একটি বিতর্কিত সংগঠনের সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ায় এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেয়। সেই সাথে তাদের বীরত্বপূর্ণ খেতাবও বাতিলের দাবি জানানো হয়।

২০১২ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নগরীর মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অলি আহমেদ একাত্তরে ‘সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে’ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলে আজগুবি ও অসত্য বক্তব্য দিয়েছিলেন। একই অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ইব্রাহিম মুসলমানেরা ‘দ্বীনি চেতনায় ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায়’ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলে আরেক মিথ্যাচারমূলক বক্তব্য দেন।

এসব মিথ্যাচারের প্রতিবাদে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ সংগঠন ছাড়াও ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ’ও মানববন্ধন এবং সমাবেশ করে অলি আহমেদ ও ইব্রাহিমকে চট্টগ্রামে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়।

এছাড়া একটি টিভি অনুষ্ঠানে লাইভে অলি আহমেদ স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে নির্জলা মিথ্যাচার করেছিলেন। জিয়াই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ২৬শে মার্চ- অবলীলায় এমন মিথ্যাচার করেন তিনি। যার প্রেক্ষিতে সাথে সাথে স্টুডিওতে কল করে এক তরুণ দর্শক অলি আহমেদকে ইতিহাস বিকৃতির দায়ে তিরস্কার করে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত রূপ, বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান, তারপর সেই ঘোষণাপত্র কারা কারা পাঠ করেন, জিয়াকে কীভাবে ঘটনাচক্রে ২৭শে মার্চ কালুরঘাটে হাজির করা হয় এবং পাঠ করানো হয়… ইত্যাদি তুলে ধরেন সেই দর্শক।

সেই দর্শক ফোনে পুরো ইতিহাস শুনিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি হয়েও কীভাবে নতুন প্রজন্মের সামনে টিভি লাইভে এমন মিথ্যাচার করতে পারলেন- এ নিয়ে বেশ তিরস্কার করেন অলিকে। পুরো সময়টা বাধ্য হয়ে চোখমুখ শক্ত করে বসে তিনি দর্শকের ফোন লাইভে শোনেন এবং চুপ করে থাকেন। আসলে দেওয়ার মত কোনো জবাব তার কাছে ছিল না। তবুও লজ্জা হয় না অলির।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে শুরু বিএনপির সাথে অলি আহমেদের অন্তরঙ্গতা:

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে অলি আহমেদ আবারও তার কৌশল বদল করেন। তিনি বিএনপির সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এমনকি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে গোপনে বৈঠকও করেন। এই বৈঠক সম্পর্কে জানাজানি হলে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে দাবি করেন, বিগত বছরগুলোতে বিএনপি পরিবারের সঙ্গে তার একটি গ্যাপ তৈরি হয়েছিল, যা এখন দূর হয়েছে। যে তারেক রহমান এবং হাওয়া ভবন সম্পর্কে এত আপত্তি এবং প্রকাশ্য নানা উক্তি, সেই তারেক সম্পর্কে বলেছেন, আমরা এখন আলাদা কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করছি না।

সেসময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতামত ছিল, নির্বাচনের আগে মহাজোটকে সমর্থন দিয়ে ফায়েদা হাসিলের তৎপরতা চালাচ্ছেন অলি। অনেকেই বলেছেন, ক্ষমতা ভাগাভাগির চিন্তায় অলি আবার বিএনপি ও জামায়াতের সুহৃদ হওয়ার তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন। খোদ নিজের এলাকাতেই অলির এমন ডিগবাজি দেখে লোকজন বলেছেন, ‘মুখের থুথু ফেলে দেয়ার পর তা পুনরায় মুখে তুলে নেয়ার অবকাশ থাকে না। কিন্তু অলির মত একশ্রেণীর রাজনীতিবিদের বেলায় তা সম্ভব।’ কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। অলির সাথে দিনদিন ঘনিষ্ঠতা বেড়ে চলেছে বিএনপি-জামায়াতের।

চন্দনাইশের সাংবাদিক আবু তোরাব বলেন, বিএনপির সঙ্গে অলি আহমেদের জোট বাঁধা এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ২০০৬ সালে অলি বিএনপি ত্যাগ করে এলডিপি গঠন করে সর্বপ্রথম গাছবাড়ীয়া কলেজ মাঠে জনসভায় বিএনপির দুর্নীতিবাজদের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আমিই খালেদা জিয়াকে রান্নাঘর থেকে রাজনীতিতে এনেছি, আবারও তাকে রান্নাঘরে ফিরে যেতে হবে। মহিলার শাড়ির আঁচলে থেকে রাজনীতি করি না, করবও না।’ এমনকি অলি ‘বিএনপিকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে কবর দেয়া হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। অথচ এখন আবার তিনি সেই মহিলার আঁচলতলায় ঘুরঘুর করছেন।

এলডিপির অন্য নেতারাও ‘জি হুজুর’ নীতিতে চলেন। চন্দনাইশ উপজেলা এলডিপির সাধারণ সম্পাদক আকতারুল আলম বলেন, ‘আমাদের কিছু বলার নেই। নেতার সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। তিনি বিএনপিতে ফিরে গেলে আমরাও যাব।’ একই মত বিএনপির নেতাদেরও। চন্দনাইশ উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মাহাদুর রহমান বলেন, ‘সরকার পতনের আন্দোলনে খালেদা জিয়া এলডিপিকে নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা তা মেনে নেবো।’ তবে চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ওয়াহিদুরজ্জামান বলেন, ‘অলির সেইদিন আর নেই, সময় ফুরিয়ে এসেছে, তাই আবোলতাবোল কথা বলছেন তিনি। এক সময় প্রচুর মামলা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তিনি ব্যাপক হয়রানি করেছেন। তবে এখন আমাদের শক্ত অবস্থান দেখে তিনি ভড়কে গেছেন।’

আরও পড়ুনঃ ২০০১-এ খালেদার আমল : বিএনপি’র রাজনীতি না করার দরুণ অকারণে চাকরি হারাতেন পেশাজীবীরা

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর জামায়াতের সাথেও প্রেম শুরু হয় অলি আহমেদের:

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত ও ছাত্রসংঘ (পরে শিবির) বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। পলাতক অবস্থা থেকে ফিরে আসে রাজাকার শিরোনমনিরা। জেল থেকে ছাড়া পায় সব যুদ্ধাপরাধী। সেই বিএনপিরই সহ-প্রতিষ্ঠাতা অলি আহমেদ। যদিও জামায়াত বিরোধিতা করে একসময় জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির সাথে দ্বন্দ্বের ফলে বিএনপির রাজনীতি ত্যাগ করেন। আবার সেই বিএনপর সাথে তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। কালক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত জামায়াতের সাথেও ঘনিষ্ঠ হয় তার প্রেম।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ক্রমশ অকার্যকর হয়ে পড়া, জোটে নিজের শক্ত অবস্থান না থাকা, আব্দুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিম নেতৃত্বাধীন এলডিপি’র আরেক অংশকে জোটের শরিক হিসেবে বিএনপির স্বীকৃতি প্রদান, সর্বোপরি জোটকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচনের আগে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির যোগদান এবং শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই বিএনপির বিজয়ীদের সংসদে যোগদানের পর আলাদা জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন অলি। যার প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে ২৭শে জুন ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (জামায়াতের অন্যতম লিয়াজোঁ), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), খেলাফত মজলিশ ও ন্যাশনাল মুভমেন্ট- এই চারটি দল নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে নতুন একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছিলেন অলি আহমেদ।

‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নিয়ে অলির হাস্যকর ব্যাখ্যা:

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থেকেও আলাদা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সে সময় অলি আহমেদ হাস্যকর অজুহাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য নিজ নিজ মঞ্চ থেকে আন্দোলন শুরুর লক্ষ্যেই এ মঞ্চ গঠন করা হয়েছে। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকে এলডিপি বহুবার তার মুক্তির জন্য সভা-সমাবেশ করেছে। আজকে যারা আমার দুই পাশে আছেন, তারা অনেকে আমার সাথে ছিলেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি, চেতনার পক্ষের শক্তি এবং জাতিকে মুক্ত করতে জাতীয় মুক্তি মঞ্চে থাকতে চায়।’

সেই জোট গঠনের ৯ মাস পর ২০২০ সালের ২৫শে মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। মুক্তির পর পরিবারের সদস্য এবং বিএনপির শীর্ষ নেতারা নিয়মিত দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ পান। এমনকি ঈদুল ফিতরের রাতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নাও পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু খালেদার মুক্তির জন্য পৃথক ‘মঞ্চ’ গঠনকারী অলিকে সাক্ষাতের কোনো সুযোগই দেননি খালেদা জিয়া। বিএনপি সংশ্লিষ্টদের দাবি, অলি আহমেদের ওপর খালেদা জিয়ার কোনো বিশ্বাস নেই। দলের নেতৃবৃন্দ নিয়ে অলির মন্তব্যই এর কারণ।

অলি আহমেদের দূরভিসন্ধি প্রকাশ হয়ে যায়:

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ ও ২০ দলীয় জোটের সাবেক শরিক একটি দলের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামী বরং কোণঠাসা অবস্থায় আছে। আর এ কারণে অলি আহমেদকে সামনে রেখে তারাই সক্রিয় হতে চাইছে। লোকবল, সাংগঠনিক পরিস্থিতি সব মিলিয়ে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য হিসেবে এলডিপি সভাপতিকে সামনে রাখছে জামায়াতে ইসলামী। ‘জামায়াতের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজন। তারা নতুন নামে আসতে চায়। নতুন সংগঠন করতে চায় (যা কয়েকদিন পর সত্য প্রমাণ হয়েছে, সৃষ্টি হয় এবি পার্টি)। যদি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও অলিকে জামায়াত পায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। দু’জনই মুক্তিযোদ্ধা, জামায়াত তো লোক দেবে, সংগঠন আছে। জামায়াতের মতো একটি সংগঠন অধীনে আছে, তাহলে মাঠ তো তিনি ভরতে পারবেন। জামায়াতের রিহ্যাবিলিটেশন তো তার হাতেই হচ্ছে।’

গত নির্বাচনের আগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক আরেকটি দলের প্রধান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর জামায়াতকে বিএনপি একপাশে ঠেলে রেখেছে, এটাই তাদের চটিয়ে দেওয়ার কারণ। তারা চাপ তৈরি করার চেষ্টা করছে অলি আহমেদকে দিয়ে। কিন্তু বিএনপি যদি তাদের বাদ রাখতে চায়, তাহলে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়ে বাদ দিক। তারা তা করবে না। তারা আমাদের, বিদেশিদের দেখাচ্ছে, এই দেখো, জামায়াত নেই আমাদের সঙ্গে। কিন্তু এভাবে তো জোটগত রাজনীতি হয় না।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘অলি আহমেদের এই ঘটনার মধ্যে প্রথম থেকে জামায়াত আছে। জামায়াত যে শুধু তার সাথে আছে তা না, তারা বিএনপির সঙ্গেও আছে। কিন্তু এইখানে প্রোঅ্যাকটিভ। বিএনপির কিছু করার নেই। ধীরে ধীরে নিজেদের নিঃশেষ করার দিকে যাচ্ছে। ফ্রন্টের ৬ মাসব্যাপী বৈঠক নেই। শেষ বিচারে শেখ হাসিনা উইনিং অবস্থানে। কোনও দিকের খোঁচানো থেকেই অলি আহমেদ মাঠে নামছেন, যদিও এটা পরিষ্কার না। বিস্ময়কর লাগে। তবে দিনশেষে সত্য হলো তিনি কিছুই করতে পারবেন না।’

আরও পড়ুনঃ লেখক-বুদ্ধিজীবীকে কুপিয়ে হত্যা, উদ্ধারকারীদের ওপরই দোষ চাপানোর চেষ্টা

জামায়াতকে আড়ালে রাখা অলির আরেক কৌশল:

‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ ঘোষণার সময় বিএনপি জোটের ৩টি শরিক দলের শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন দলের কয়েকজনকে নিজের দিকে টানলেও এই মঞ্চে অলির প্রত্যাশা ছিল মূলত জামায়াত নেতাদের। কিন্তু কৌশলগত কারণে জামায়াত সেসময় আড়ালেই ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অলির সাথে প্রকাশ্যে মাখামাখি দেখা যাচ্ছে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহামন, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক মজিবুর রহমান, তাসনীম আহমেদ, মাওলানা আব্দুল হালিমদের। এই জামায়াত নেতাদের খুশি করতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অলি আহমেদকে বলতে শোনা গেছে, ‘জামায়াত এখন দেশপ্রেমিক শক্তি’।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জামায়াতের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলেই নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করে বিএনপির সঙ্গ পুনরায় ত্যাগ করবেন অলি আহমেদ। সরকার পতনের স্বপ্ন দেখা অলি ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে জামায়াতের লোকবল, আর্থিক সহযোগিতা এবং লজিস্টিক সাপোর্টের প্রত্যাশা করছেন। বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অলি আহমেদের সঙ্গে নতুন জোট গঠনের খবরটি অসত্য। সুতরাং এই অসত্য বিষয়ের ওপর কোনো বক্তব্য দিতে পারব না। যে বিষয়ের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, সে বিষয় নিয়ে কেন কথা বলতে যাব?’

আর অলি আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি কথাও এখন বলব না। কিছু বলার থাকলে মিডিয়াকে ডেকে বলব। সেখানে আপনাকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে।’

জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক মুছতে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা অলির:

২০১৯ সালের ২৭শে জুন ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’র ঘোষণা দেওয়ার অনুষ্ঠানে জামায়াতের সাফাই গেয়ে অলি আহমেদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সব দলকে আমরা সঙ্গে নেবো। জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করলো কারা, অন্যের ঘাড়ের ওপর বন্দুক রেখে কথা বলা ঠিক না। সব সময় আমি অন্যকে দোষ দিয়ে আগাবো এটা ঠিক না। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ১৯৭১ সালের জামায়াত এবং ২০১৯ সালের জামায়াত এক নয়। দেশকে তারা অনেক ভালোবাসে, তাদের মধ্যে অনেক সংশোধনী এসেছে।’

এ সময় দর্শক সারিতে থাকা জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে হাত তালি দেন।

অলি আহমেদের দাবি, জামায়াত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তারা দেশপ্রেমিক শক্তি। যারা দেশকে ভালবাসে, দেশকে মুক্ত করতে চায়, দেশবাসীকে মুক্ত করতে চায়, যারাই আমাদের সঙ্গে আসতে চাইবে তাদেরকে আমরা সঙ্গে নেবো। তবে দালাল-বেঈমানদের না। এ সময় এক সাংবাদিক ‘দালাল- বেঈমানদের’ পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারা যে দালাল-বেঈমান এটা কারও অজানা না। আমাদের অনেকে দালালি করেছে বলে আজকে জাতির এই অবস্থা। আমাদের সঙ্গের সিনিয়র লোক তাদেরকে চেনেন, তারা জানেন গত ১০-২০ বছর ধরে কীভাবে তারা দালালি করছে।’

যথারীতি সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, জাগপা নেতা তাসমিয়া প্রধান, খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা আহমদ আলি কাসেমী, শিবির নেতা মুহিব খান, গোলাম মাওলা রনি প্রমুখ। সবাই পরিচিত মুখ এবং জামায়াতপন্থী হিসেবে প্রত্যেকেই চিহ্নিত।

আরও পড়ুনঃ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সফলতায় বিএনপি চুপসে গেছে

জামায়াতের সাথে মাখামাখি ও বিএনপির সমালোচনা দেখে অলির সঙ্গ ছাড়লেন দলের ২ শতাধিক নেতা-কর্মী:

অলি আহমেদের রাজনৈতিক ডিগবাজি দেখে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে এ বছরের মে মাসে এলডিপি থেকে সরে গেছেন দুই শতাধিক নেতা-কর্মী, যাদের মধ্যে আছেন একজন সহসভাপতি এবং একজন যুগ্ম মহাসচিবও। তাদের অভিযোগ, অলি আহমেদ বিএনপি থেকে বের হয়ে যে কথা বলে এলডিপি গঠন করেছিলেন, সেই লক্ষ্য থেকে তিনি বিচ্যুত হয়েছেন। তার দলে গণতন্ত্র নেই। তিনি নিজের মনমতো কাজ করেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন, তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে ক্রমাগত কথা বলেন।

এলডিপির সহসভাপতি আবু জাফর সিদ্দিকী এবং যুগ্ম মহাসচিব তমিজউদ্দিন যৌথ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠিয়ে পদত্যাগের বিষয়টি জানান। তাদের ভাষ্য, তারা ‘বড় বড়’ রাজনৈতিক দলে যোগদানের প্রস্তাব পেয়েছেন। শিগগিরই পছন্দসই দলে যোগ দেবেন। তবে সরকারি দল থেকে অফার পাননি বলে নিশ্চিত করেন তারা।

অন্যদিকে অলির দাবি, যারা পদত্যাগ করেছেন তারা দুষ্কৃতিকারী। তারা সরে যাওয়ায় দল পূতপবিত্র হয়েছে। অলি আহমেদের এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন, ‘এতেই উনার (অলি আহমেদের) মানসিক দৈন্যতা ফুটে ওঠে। রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। আমরা পদত্যাগকারীরা যদি দুষ্কৃতিকারী হই, অলি সাহেবও বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তা হলে তিনিও কি দুষ্কৃতিকারী? তার পদত্যাগে বিএনপি পবিত্র হয়েছে বলা যাবে? এটা আমার প্রশ্ন। আসলে উনার বয়স হয়েছে, তাই মতিভ্রম হয়েছে।’

পদত্যাগকারীরা অলির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন, তার কোনোটিই মিথ্যে নয়। তারা জানান, ২০০৬ সালে অলির নেতৃত্বে বিএনপি থেকে বের হয়ে এলডিপির আত্মপ্রকাশের পর থেকে দলটির সঙ্গে সক্রিয় হন তারা। দল প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ১৬ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত ডিগবাজি দিয়ে গেছেন অলি আহমেদ। ফলে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতারা তার নেতৃত্ব ত্যাগ করেছেন। ডিগবাজি থেকে অলি আহমেদ সরে আসেননি, বরং দিনে-দিনে দলকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন।

জামায়াতের সঙ্গে অলির ঘনিষ্ঠতা নিয়েও ইঙ্গিত করা হয় তাদের বিবৃতিতে। বলা হয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক হয়ে ১০ বছর ধরে জোটবিরোধী কার্যক্রম করেছেন। অবস্থান নিয়েছেন জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জামায়াতের সাথে তার চরমমাত্রার ঘনিষ্ঠতা এলডিপির রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্যকে দলিত-মথিত করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এলডিপি একটি হাস্যকর প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। উনি সবসময় বলতেন, জামায়াতকে পছন্দ করেন না, অথচ কয়েকদিন আগে দেখি জামায়াতের সেক্রেটারির সঙ্গেই উনি মিটিং করছেন।

অলি আহমেদকে কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের উল্লেখ করে বলা হয়, “দল পরিচালনার ক্ষেত্রে অলি আহমেদ চূড়ান্ত অর্থে ‘কর্তৃত্ববাদী ও আত্মঅহংকারে’ নিমগ্ন একজন মানুষ। অথচ জাতীয়তাবাদী শক্তির আধার হিসেবে শত শত তরুণ-যুবক ও রাজনীতিক তার নেতৃত্বের ছায়াতলে এসেছিল। কিন্তু দিন যত বয়েছে, তার পরিবর্তিত রূপ দেখে নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়েছে, ভেঙে পড়েছে। তিনি তার মনমতো দলীয় পদ ব্যবহার করেছেন, বাঁটোয়ারা করেছেন। নিজের মনমতো পদে বসান বা পদ থেকে সরান। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ন্যূনতম যে অঙ্গীকার থাকে, তা তিনি স্পষ্টরূপে দীর্ঘদিন ধরে ব্যত্যয় করে এসেছেন।”

অলির সর্বশেষ অবস্থান:

গত ১৫ই সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে একপাশে এবং অন্যপাশে জামায়াত নেতা আবদুল হালিমকে বসিয়ে অলি আহমেদ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘আমার পাশে জামায়াত বসে আছে। এখন যদি বিএনপি পাশে বসে, তাহলে ওরা (আওয়ামী লীগ) জান বাঁচানোর রাস্তা খুঁজে পাবে না। শুনছি আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগে জান বাঁচানোর প্রস্তুতি নেন। নির্বাচন নয়, জান বাঁচানোর প্রস্তুতি নেন। পৃথিবীতে যত স্বৈরাচার ছিল তাদের করুণ পরিণতি হয়েছে, এদেরও হবে।’

প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও হুমকি-ধমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব অফিসার এ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করেছে, তাদের তালিকা করছি। তাদের আগে জেলে পাঠাতে হবে। যারা পেনশনে গেছেন, তাদের পেনশন বাজেয়াপ্ত করতে হবে। তারা জাতীয় শত্রু।’

পরিশেষ:

জামায়াতের কোলে চড়ে বিএনপিকে পাশে পাওয়ার পেছনে অলি আহমেদের এই আকুতির লক্ষ্য একটাই, ক্ষমতার মসনদ। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা অলি আহমেদ জীবনের শেষ সময় আবারও গদিতে বসতে চান। স্বপ্ন দেখেন জামায়াত কোনো না কোনোভাবে ঠেলে সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলবে। কিংবা বিদেশি কেউ কোলে করে তাকে অন্তত একটা ছোটখাট গদিতে বসিয়ে দেবে। সেই আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন অলি।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, আজ যদি তিনি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে একটা আশার বাণী শোনেন, তিড়িং করে বানরের মত আরেক ডিগবাজি দিয়ে ফেলতে দেরি করবেন না। তখন কোথায় যাবে জামায়াত, কোথায় যাবে বিএনপি, কোথায় যাবে তার বন্ধু ইব্রাহিমের কল্যাণ পার্টি আর কোথায় যাবে নিজের দল এলডিপি! সব ছেড়েছুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের পায়ে পায়ে ঘুরবেন অলি।

তবে একটা অমোঘ সত্য হলো, আওয়ামী লীগ মুখ থেকে ছুড়ে ফেলা থুথুর দিকে ফিরেও তাকায় না, এটা অলি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তাছাড়া জামায়াতের সাথে যাদের সখ্য, তাদের সাথে আওয়ামী লীগের কখনই হতে পারে না কোনো ঐক্য।

আরও পড়ুনঃ

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে