আশির দশকে ঢাকায় হটকেকে পরিণত হয় জাপান মেড ক্যাসিও ঘড়ি। হুবহু একই রকম দেখতে নকল ঘড়িও ঢোকে দেশের বাজারে। মাত্র ১শ টাকায় ক্যাসিও ব্র্যান্ডের ছাপ মারা ঘড়িতে সয়লাব হয়ে যায় ফুটপাতও। তরুণ থেকে বৃদ্ধ, সবার হাতে হাতে সেই ঘড়ি। এরশাদ সরকার তখন ক্ষমতায়। অর্থ মন্ত্রণালয় তখন অতিষ্ট হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানালো, প্রচুর নকল ঘড়ি চোরাচালান হয়ে আসছে। এতে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। বিমানবন্দরে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হলো। কিন্তু কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না।
পরে অর্থ মন্ত্রণালয় নিজস্ব সার্ভেইল্যান্স টিম বসলো বিমানবন্দরে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো, এক তরুণ পুরো বিমানবন্দরে গ্যাং অপারেট করছে। আর সকল স্তরের কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে নকল ক্যাসিও ঘড়িসহ নানা চোরাই পণ্য বাংলাদেশে ঢোকাচ্ছে। বিমানবন্দর এলাকায় তার নাম হয়ে গিয়েছিল ক্যাসিও বাবর। বড় একটি চোরাচালান চক্রের নেতা তিনি। থানা-পুলিশ সবই তার পকেটে। চোরাচালানের দায়ে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে মোট দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো ঠিকই, কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পরই তিনি হাসতে হাসতে থানা থেকে বেরিয়ে যান। বহাল তবিয়তে চোরাচালান করে তিনি সেই আমলেই বনে গিয়েছিলেন কোটিপতি। বিমানবন্দরে লাগেজ টানা সিন্ডিকেটের হোতা বাবরের আরেকটি নাম ছিল ‘লাগেজ বাবর’।
‘৯১-তে বিএনপি ক্ষমতায় এলে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের (পরবর্তীতে খাম্বা মামুন) মাধ্যমে বাবরের পরিচয় হয় তারেক রহমানের সঙ্গে। গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। তারেক রহমানের যখন যা প্রয়োজন হয়, সেটা যে কোনো দেশেই থাকুক না কেন, বাবরকে জানালে তাৎক্ষণিক হাজির হয়ে যেত ঢাকায়। এমনই ছিল তার নেটওয়ার্ক। বিনিময়ে তারেকের ব্যাকিংয়ে বিমানবন্দরের অঘোষিত মালিক বনে যান তিনি। পারস্পরিক সমঝোতা এমন পর্যায়ে ছিল যে, তারেকের যাবতীয় অপকর্মের দোসর এবং ম্যানেজার বনে যান বাবর। বিভিন্ন ফাইফরমাশ থেকে শুরু করে একান্ত গোপনীয় কাজও সামলে নেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বাবর তখন জোর তদ্বির চালান বড়সড় ক্ষমতা হাসিলের জন্য। তারেকের একান্ত আস্থাভাজন হিসেবে তার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে ঠিকই। সেই সরকারের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বড় চমক ছিলেন লাগেজ বাবর ওরফে লুৎফুজ্জামান বাবর। ফ্রিতে ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে পারেননি, এজন্য তারেককে অকল্পনীয় অঙ্কের অর্থ দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মত রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। তবে কিছুদিনের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেনকে সরিয়ে বাবরকেই দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব দায়িত্ব।
[আপনি জানেন কি, বিএনপির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের নাম কেন ‘লাগেজ বাবর’ ছিল?]
গোল্ডেন মনির, সিলভার সেলিম, খাম্বা মামুনসহ ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে চোরাচালানের কাজ করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন বাবর। নির্বাচনে বিশাল ছক্কা হাঁকিয়ে অতীতের পরিচয় ঢেকে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। হাওয়া ভবনের নিলামে বাগিয়ে নেন প্রতিমন্ত্রীর গদি। বেশভূষায় আসে পরিবর্তন। ইংরেজি-বাংলার মিশেলে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলে গণমাধ্যমের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। হাওয়া ভবন মাফিয়া সাম্রাজ্যের অধীনস্ত সকল ধরণের সিন্ডিকেট বাণিজ্যের অন্যতম হোতা ছিলেন লাগেজ বাবর।
ক্ষমতায় বসে এহেন কোনো অপকর্ম নেই যা তারেক বাবরকে দিয়ে করাননি। ভারতের ভেতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে নিয়োজিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য আনা চোরাচালানকৃত অস্ত্রের ডেলিভারি নিশ্চিত করা হয় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীর আয়ত্বাধীন চট্টগ্রামের সার কারখানার জেটিতে খালাস হয় সেই অস্ত্র। তবে এক সৎ ও নির্ভিক পুলিশ কর্মকর্তা সেই অস্ত্র চোরাচালান আটক করেন। সংবাদকর্মীরা খবর পেয়ে গেলে তারেক-বাবর-নিজামিদের সেই পরিকল্পনা কেঁচে যায়।
দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএনপি সরকার অস্ত্র চোরচালান আটকের ঘটনা স্বীকার করে বাহবা কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকায় একটা ছবি এখনও প্রায়শ চোখে পড়ে- চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, পরনে সাদা পাঞ্জাবি, হাতে রকেট লঞ্চার নিয়ে নেড়েচেড়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন এই অস্ত্র চোরাচালানের অন্যতম হোতা লুৎফুজ্জামান বাবর।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে আটক ১০ ট্রাকের বহরের সেই বিশাল অস্ত্রের পাহাড় দেখতে পরদিন চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইন্স মাঠে গিয়েছিলেন বাবর। ছবি তোলার কিছুক্ষণ পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাবর মন্তব্য করেন, এই অস্ত্র আনার সঙ্গে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের যোগসূত্র থাকতে পারে। যদিও পরবর্তীতে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, তিনি নিজেই এর সঙ্গে জড়িত। আদালতের রায়ে বাবরসহ ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। বাবর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের ৭ বছর পর ২০১৪ সালের ৩০শে জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। এর ৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ই অক্টোবর ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বাবরসহ ১৯ জনের ফাঁসির রায় দেন আদালত।
[আপনি জানেন কি, বিএনপির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের নাম কেন ‘লাগেজ বাবর’ ছিল?]
এক যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন বাবর। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে তার। বিএনপির নেতা-কর্মীরা দূরে থাক, ২০১৮ সালের নভেম্বরের পর থেকে পরিবারের সদস্য বা আইনজীবীরা কেউই দেখতে যাননি তাকে। নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত বাবর কারাগারে বসেই শোনেন চাঞ্চল্যকর দুই মামলায় তার ফাঁসির রায়। আগের সেই জেল দিয়ে স্পাইক করা চুল নেই, দিনে তিন বেলা ঝকঝকে নতুন নতুন শার্টের বাহার নেই। বরং আলখেল্লা, লম্বা দাড়ি, হাতে তসবিহ উঠেছে। বাবর এখন অন্য মানুষ। জেলে সারাক্ষণ জিকির করেন আর তারেককে গালাগালি করেন।
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলাসহ ১৯টি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি বাবর। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে সকল ধরণের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গুম-খুন ইত্যাদি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব ছিল বাবরের। অনেক সময় এমনও হয়েছে, কোনো ক্রাইম ঘটার পর তারেক তাকে ফোন করে সেটা ম্যানেজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর নির্দেশ পেয়ে সেসব ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকেও সেখানে অপব্যবহার করেছেন।
তবে, এসব বাবরের মূল কাজ ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদে দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। বাবরের বক্তব্য অনুযায়ী, তার আসল কাজ ছিল তারেক ও তার বন্ধু খাম্বা মামুনের চোরাচালানের ব্যবসা দেখা। এই লাইনে বাবরের বিপুল অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তারেক-মামুন চোরাচালানের নতুন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। সেই ব্যবসা যেন ঝামেলামুক্ত থাকে, দেখার দায়িত্ব ছিল বাবরের ওপর। তারেকের সাথে পরিচয়ের আগের জীবনে বাবর মূলত চোরাচালান করতেন দামি ঘড়ি, সোনা, বিদেশি সিগারেট, বিদেশি মদ ইত্যাদি। রুটগুলোও ছিল তার নখদর্পণে। চোরাচালান করে বিপুল সম্পদ বানিয়েছেন বাবর।
২০০১ সালে দ্রুত টাকা বানাতে এই ব্যবসাতে গুরুত্ব দেন খাম্বা মামুন। আর ব্যবসা গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে বাবরের কাঁধে। বিনিময়ে বাবর বাগিয়ে নেন নেত্রকোনা থেকে বিএনপির সংসদ সদস্য পদের মনোনয়ন। চোরাচালান ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থের বড় একটা অংশ দিতে হয় তারেককে। ২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনের পর তারেক যখন বাবরকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার অফার করেন, তখন খালেদা জিয়া পর্যন্ত হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীদের তারেকের ইচ্ছারই জয় হয়।
[আপনি জানেন কি, বিএনপির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের নাম কেন ‘লাগেজ বাবর’ ছিল?]
বাবরের স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে গুলশানের বাসায় থাকেন। তার বড় ছেলে আগে দেশের বাইরে থাকলেও এখন দেশে আছেন। তিনিই পরিবারের দেখভাল করেন। অদৃশ্য কারণে বিগত প্রায় ৪ বছরে একবারও বাবরের সাথে দেখা করেননি তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে দলীয় হাইকমান্ডকে তার (বাবর) সাজা মওকুফ কিংবা মুক্তির বিষয়ে একাধিকবার তদবির করা হলেও কোন কাজ হয়নি। দলের কাছে প্রায় অচ্ছুত হয়ে পড়েছেন বাবর। এছাড়া তারেক রহমানের অপরাধ সঙ্গী হওয়ায় অনেকেই ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে বাবরের বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখেন না বলে জানা গেছে।
কারাগার সূত্র বলছে, ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে কারাগারে বাবর চুপচাপ থাকেন, আগের মতো হম্বিতম্বি নেই। মৃত্যুর প্রহর গুনছেন নিঃসঙ্গ সেলে বসে। রায় কার্যকর হলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, বন্দিদশা তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলেছে অন্য কয়েদিদের মত।
আরও পড়ুনঃ
- বানরের মত ডিগবাজি দিয়ে আবারও জামায়াতের কোলে অলি, নয়া ষড়যন্ত্র শুরু
- শামা ওবায়েদ: রাতে হুইল চেয়ারে, সকালে সাজগুজ করে রাষ্ট্রদূত এর সাথে
- EXCLUSIVE || যুবদলকর্মী শাওনের মৃত্যুঃ বিএনপি কর্মীদের ছোড়া ইটের আঘাতে
- বিএনপি-জামায়াতের শাসনামের ২০০১ সালের দুর্গাপূজা কেমন ছিল?