বিএনপির নারী নেত্রীরা যার কারণে তটস্থ থাকেন, যাকে এড়িয়ে চলেন বিবিধ বদঅভ্যাসের কারণে, তিনি হলেন জয়নুল আবেদীন ফারুক। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় চিফ হুইপ এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী এই নেতা নারী লোলুপতার কারণে দলে কুখ্যাত। এমনকি তিনি তারেক রহমান ও তার স্ত্রী-কন্যাদের জন্য উপহারসামগ্রী নিয়ে লন্ডন সফরে গেলে তার সাথে কিংস্টনের বাড়ির গেস্টরুমে দেখা করেন তারেক, তার স্ত্রী-কন্যাদের উপহার নিজে রিসিভ করেন। তাদেরকে লম্পট জয়নুল আবেদীনের সামনে আনেননি তারেক। এমন একটা খবর প্রকাশিত হয়েছিল বছরখানেক আগে।
সেই জয়নুল আবেদীনের লাম্পট্যের কিছু ঘটনা জানা যাক।
ঘটনা-১ : নারী সাংবাদিককে ধর্ষণচেষ্টা
২০১৩ সালের ঘটনা। ২৮শে সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার দিকে একজন নারী সাংবাদিক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদীন ফারুকের সংসদ ভবন সংলগ্ন ন্যাম ফ্ল্যাটে সাক্ষাৎকার নিতে যান। এ সময় ফারুক তাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলেন। কিছুক্ষণ বসার পর ফারুক তাকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে যান। এরপর তাকে জোর করে নিপীড়ন করেন। এ সময় ওই নারীর চিৎকার করতে করতে ফারুকের শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বাইরে উপস্থিত লোকজনকে ঘটনাটি জানান। ফারুক এ সময় দ্রুত সটকে পড়েন ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে।
সেদিনই ওই নারী এই বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ফারুক তার মেয়ে তামান্না ফারুক থীমাকে দিয়ে একটি জিডি করিয়ে উল্টো বাদীকে হয়রানির চেষ্টা করেন। দাবি করেন, রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা হয়েছে। যদিও বাদী সেদিনের ঘটনায় মামলায় ৫ জনকে সাক্ষী করেছেন। যারা সেদিন ন্যাম ভবনে বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। এমনকি সেদিন তিনি ন্যাম ভবনে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন, তার উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে ভিজিটর রেজিস্ট্রারে। অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে ফোনে যোগাযোগের পর জয়নুল আবেদীন ফারুকের সম্মতিতেই ওই সাংবাদিককে ওপরে পাঠানো হয়েছিল।
যদিও ফারুক পরবর্তীতে দাবি করেছেন, ওই নারী সাংবাদিককে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, তার সঙ্গে কখনো সাক্ষাৎ বা ফোনালাপও হয়নি!
সর্বশেষ জানা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে এবং আপসরফার মাধ্যমে ফারুক এই মামলাটি প্রত্যাহার করান। এক্ষেত্রে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনও করতে হয়েছিল তাকে।
ঘটনা-২ : যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি নেতার স্ত্রীর সাথে লাম্পট্য
এই ঘটনাটিও ২০১৩ সালের। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ। সেখানে তিনি সপরিবারে বসবাস করেন। তার স্ত্রী একজন মার্কিন নাগরিক। মাঝে মাঝে দেশ থেকে ফোন করে রহমত ও তার স্ত্রীর সাথে টেলিফোনে কথাবার্তা বলতেন জয়নুল আবেদীন ফারুক। সেসব ছিল সাধারণ কথোপকথন আর খোঁজ-খবর নেওয়া। দলের একজন প্রবাসী নেতার সাথে যোগাযোগ দোষণীয় কিছু না। তবে হঠাৎ বাংলালিকস নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে জয়নুল আবেদীন ফারুক ও রহমতের স্ত্রীর কিছু ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায়।
অত্যন্ত নোংরা ও আপত্তিকর ভাষায় ফারুক সেসময় রহমতের স্ত্রীকে বাজে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। লজ্জায় রহমতের স্ত্রী তার স্বামীর কাছে বিষয়টি না জানালেও বাংলালিকস-এর ফাঁসকৃত ফোনালাপের বরাতে রহমত বিষয়টি জানতে পারেন। এ ঘটনার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রহমত এবং ফারুকের বিরুদ্ধে মানহানি মামলার প্রস্তুতি নেন। পাশাপাশি তিনি ফারুকের ইমপিচমেন্টেরও দাবি জানান। কিন্তু লাম্পট্য বিএনপিতে কোনো অপরাধ নয়। দলের নেতাদের অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়া তাদের চিরাচরিত অভ্যাস। তারেক-মামুন থেকে শুরু করে বহু নেতারই এমন নোংরা অতীত আছে। তাই দল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সেই ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে রহমত ও তার স্ত্রীর সম্মানহানি ঘটে। সেসময় গণমাধ্যমের কাছে আক্ষেপ করে রহমত জানান, তার স্ত্রী মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। স্বামীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কথা ভেবে জয়নুল আবেদীন ফারুককে মুখের ওপর ধমক দিতে না পেরে তার স্ত্রী টেলিফোনে কথাগুলো নীরবে শুনে যান। জয়নুল আবেদীন ফারুক একজন লম্পট চরিত্রের মানুষ বলেই তার অপেক্ষাকৃত সহজ-সরল স্ত্রীকে আজে-বাজে প্রস্তাব দিতে সাহস করেছেন।
সেসময় রহমত আরও জানান, ডার্কেন অ্যান্ড অ্যালিস নামে যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা একটি ল’ ফার্মের সঙ্গে তিনি এরই মধ্যে কথা বলেছেন, মামলার প্রস্তুতি চলছে।
রহমত বলেন, আমার স্ত্রী একজন মার্কিন নাগরিক। তাকে টেলিফোন করে যেসব আজে-বাজে কথা বলা হয়েছে এবং প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তার জন্য একজন নাগরিক হিসেবে মার্কিন বিচারব্যবস্থার সহযোগিতা তিনি চাইতে পারবেন বলেই প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে ল’ ফার্মটি।
ফারুকের টেলিফোন কলগুলো বাংলালিকস ছাড়াও তার স্ত্রীর মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা রয়েছে, সেগুলোসহ অন্যান্য ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে শিগগিরই মামলাটি করতে চাইছেন রহমত। এছাড়া, দেশেও একটি মামলা করতে চান রহমত। তিনি বলেন, এই ব্যক্তির কারণে তার ও তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের সন্তান রয়েছে তার ওপরও পড়ছে এর প্রভাব। তার স্ত্রী মানষিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হয়েছে।
রহমত জানালেন, মাত্র এক বছরের কিছু সময় আগে (২০১১-২০১২) ফারুকের সঙ্গে তার ও তার স্ত্রীর সাক্ষাৎ হয়। ফারুক যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে শিকাগো গেলে রহমত তার বাসায় দেওয়া একটি ইফতার পার্টিতে তাকে দাওয়াত করেন। সেখানেই তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ফারুকের। এরপর অক্টোবরে আরও এক দফা যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে শিকাগোতে ফারুকের বাড়িতে চার দিন থাকেন। ফারুক যুক্তরাষ্ট্র এসে ক্যাসিনোতে হাজার হাজার ডলার খুইয়ে বিপাকে পড়লে রহমতই তাকে উদ্ধার করেন। তার হোটেল বিল, খাবার খরচও বহন করেন বলে জানান তিনি।
রহমত বলেন, টাকা পয়সা নেই এমন কথা বলাতেই নিজের বাড়িতে থাকতে দেই। কিন্তু ৬৪ (সেসময়) বছর বয়সের এক বৃদ্ধের, যার নিজেরও আমার স্ত্রীর বয়সী দুটি মেয়ে আছে সে এমন আচরণ করতে পারবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। ফারুক আমার স্ত্রীকে বাজে প্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে- তার কাছে অস্ত্র আছে বলেও শাসিয়েছেন। দেশে গিয়ে বিএনপি অফিসের সামনে অবস্থান নিয়ে এমন ঘটনার প্রতিবাদ করবেন বলেও জানালেন রহমত। এছাড়া আইন-ও-শালিস কেন্দ্রের সহায়তা চাইবেন বলেও জানান তিনি।
রহমত বলেন, আমি আশা করবো দল এমন একজন লম্পটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আর দল যদি নাও নেয় আমি একাই এর শেষ দেখে ছাড়বো। স্ত্রীর প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। আমি তাকে মোটেই অবিশ্বাস করছি না। জয়নুল আবেদীন ফারুকই তাকে আজে-বাজে কথা বলেছেন। আমাদের ক্ষতি যা হবার হয়েছে, কিন্তু এমন ব্যক্তিকে আমি ছেড়ে দেবো না, বলেন রহমত উল্লাহ।
[খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন ফারুকের যৌনলীলার ইতিহাস!]
এসবই ২০১৩ সালের হিসাব-নিকাশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি জয়নুল আবেদীন ফারুকের বিরুদ্ধে। এমন একটি দলের তিনি প্রভাবশালী সদস্য, যে দলের প্রধান মাফিয়া সর্দার তারেক রহমানের ছত্রছায়ায় তিনি থাকেন, যেখানে দলের কম গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এমন ‘সামান্য’ অভিযোগ কেউ গ্রাহ্যই করবে না। তারা তা করেওনি। রহমত উল্লাহকে শাসানো হয় এবং ভবিষ্যতে দলের পদ-পদবী পেতে তার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এছাড়া কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে আপোসে মীমাংসা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সবই করা হয় দলের ভাবমূর্তি রক্ষার নাম দিয়ে।
এবারও বেঁচে গেলেন লম্পটরাজ জয়নুল আবেদীন ফারুক।
তবে এখনও পর্যন্ত দলে তার ভাবমূর্তি আগের মতই আছে। নারী নেতা-কর্মীরা তাকে এড়িয়ে চলেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষে ফেনী জেলা বিএনপি একটি সমাবেশ আয়োজন করেছিল। সেসময় ফারুকের উপস্থিতি নিয়ে বিভক্ত হয়ে যায় বিএনপি।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেন, অনেক টাকা খরচ করে সমাবেশের প্রস্তুতি শেষের দিকে। কিন্তু যখনই স্থানীয় নেতারা জানতে পেরেছেন সমাবেশে জয়নাল আবেদীন ফারুক আসবেন, তখন থেকেই বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা বলছেন চরিত্রহীন, পরকীয়াবাজ নেতা ফারুক যদি সমাবেশে আসে তাহলে স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতাই সমাবেশে আসবে না। এমন একজন বিতর্কিত চরিত্রের নেতার কারণে দলের তরুণ প্রজন্মের কর্মী সমর্থকদেরকে কুশিক্ষা দেবে।
জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খোন্দকার বলেন, বিএনপির মহাসমাবেশ সফল করার জন্য যুবদলের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। কিন্তু জয়নাল আবেদীন ফারুকের আগমন নিয়ে নতুন ঝামেলা তৈরি হয়েছে। এমনিতেই দলীয় গ্রুপিংয়ের কারণে নেতা-কর্মীর অভাব। তার ওপর ফারুক ভাইকে অশুভ মনে করেন নারী নেত্রীরা। তারা অস্বস্তিবোধ করেন।
জুলফিয়া আক্তার নামে জেলা মহিলা দলের এক নেত্রী বলেন, চরিত্রহীন, পরকীয়াবাজ নেতা জয়নাল আবেদীন ফারুক যদি সভামঞ্চে থাকেন তাহলে তিনি নারী নেত্রীদের কুনজরে দেখবেন। তার উদ্দেশ্য লুচ্চামি করা। নিজ দলের তৃণমূল নেতার স্ত্রীর দিকে যে নেতা বদনজর দিতে পারেন, তার ওপর কোনো ভরসা নেই। উনি এলে আমরা সমাবেশে যাবো না।
শেষ পর্যন্ত সেই সমাবেশে যোগ দেননি দলের অনেক নারী নেত্রী ও কর্মী।
আরও পড়ুনঃ