লন্ডনে তারেক জিয়া ও ভোঁতা মালেকের মাফিয়া সাম্রাজ্য এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের গোমর ফাঁস

0
840
লন্ডনে

দুর্নীতি, অর্থ পাচার, গ্রেনেড হামলায় মানুষ হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির পলাতক নেতা তারেক রহমান লন্ডনে চাকরি-ব্যবসা ছাড়া কীভাবে টিকে আছেন, এ নিয়ে প্রশ্ন করায় টিভি টকশোতে রীতিমত তেড়েফুঁড়ে উঠেছিলেন বিএনপির নেতা রবিউল আলম রবি। একই অবস্থা অনেকেরই। কেউই বলতে চান না যুক্তরাজ্যে তারেক রহমান ও তার পরিবারের বিলাসী জীবনের পেছনে আয়ের উৎস সম্পর্কে। জানা গেছে, তারেক রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি আব্দুল মালেক ওরফে ভোঁতা মালেকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল সিন্ডিকেট। অনেকেই যার নাম দিয়েছেন হাওয়া ভবন-২ সিন্ডিকেট।

লন্ডন থেকে তারেক-মালেক গংয়ের এই সিন্ডিকেটই মূলত নিয়ন্ত্রণ করে বিএনপি’র রাজনীতি। সবকিছুর রিমোট কন্ট্রোল তাদেরই হাতে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের কবলে জিম্মি ছিল রাষ্ট্র ও প্রশাসন। সবাই তখন জানত মন্ত্রিসভার বাইরে হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটই হচ্ছে প্রশাসনের চালক। ঠিক একই কায়দায় যুক্তরাজ্যেও তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে হাওয়া ভবনের আদলে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বিএনপির রাজনীতির নিয়ন্ত্রক এই সিন্ডিকেট। মাঠের নিবেদিত কর্মীরা পাত্তা না পেলেও সিন্ডিকেটের গুডবুকে ঢুকতে পারে তারাই, যারা বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে পদ-পদবী কিনতে পারে।

আরও পড়ুন:  এক্সক্লুসিভ: ছাত্রদলের নতুন কমিটি দিয়ে ১০০ কোটি টাকা বাণিজ্য তারেক জিয়ার

হাওয়া ভবন-২ সিন্ডিকেটে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন হাওয়া ভবন-১ এর পুরাতন সদস্যদের অনেকেই। বিগত ইউপি, পৌর এবং উপজেলা নির্বাচন মনোনয়ন বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিল যৌথ এই সিন্ডিকেট। দেশে অনেক জেলা এবং থানা কমিটি গঠনেও রয়েছে সিন্ডিকেটের প্রভাব। কমিটি ও মনোনয়ন বাণিজ্যে বিশাল অঙ্কের টাকা লেনদেনও হয় এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। তাই অনেক টাকাওয়ালা ব্যবসায়ী দলীয় পদ পদবী নিশ্চিত করতে তদবিরের জন্য হরহামেশাই বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে আসতে দেখা যায়। তারা কেউই সরাসরি তারেক রহমানের সাক্ষাৎ পায় না। ধাপে ধাপে মালেক ওরফে ভোঁতা মালেকের দরবার পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। মালেকই তারেকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। টাকা দিয়েও পদ না পাওয়ার ঘটনা নিয়ে বছরখানেক আগে সিলেটে ভোঁতা মালেকের বাড়িতে হামলা করেছিলেন নেতা-কর্মীরা।

বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন এবং দলীয় পদ-পদবী পাওয়া সিন্ডিকেটের মর্জির উপর নির্ভর করে। সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করা গেলে দলীয় ত্যাগী নেতাদের পেছনে ফেলে পদ এবং নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া নিশ্চিত। যা ওপেন সিক্রেট। আবার সিন্ডিকেটের বিরাগভাজন হলে যত ত্যাগই স্বীকার করুন না কেন বিএনপির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ। এমন উদাহরণ অনেক। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে রাজনীতি করে আসছেন, এমন অনেক সিনিয়র নেতা তারেকের বিরাগভাজন হওয়ায় দলত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ বারবার বহিষ্কৃত হচ্ছেন।

তাই বলা হয়, বিএনপির রাজনীতিতে কর্মীদের মাঠে থাকার দরকার হয় না। ‘তারেক ভাইয়ার’ সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করলেই চলে। এই ভাইয়া গ্রুপের সুনজরে থাকলে দলীয় পদ-পদবী পেতে মাঠ, ময়দান, রাজপথ কোথাও উপস্থিতির দরকার হয় না। আর ভাইয়া গ্রুপের বিরাগভাজন হলে কপালে শনি জুটবে। রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের শিকার হতে হবে; যার ফলে ঘরের চালায় মাদক রেখে ফাঁসানো, রাজনৈতিক হামলাসহ বিভিন্ন ধরণের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সাইফুর রহমান গ্রুপের হাতে যেভাবে ইলিয়াস আলী গুম হয়েছিল, ঠিক সেভাবে। আবার সেই ঘটনা নিয়ে মুখ খুলে তারেক রহমানের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল মির্জা আব্বাসের মত সিনিয়র নেতাকেও। তাই বলা যায়, সিন্ডিকেটই সব কিছু। তারেক নিজে ক্যাসিনোতে বসে জুয়া খেলে, মদ খেয়ে সময় কাটালেও সব কিছু সামাল দিতে রয়েছেন ভোঁতা মালেক।

হাওয়া ভবন-২ সিন্ডিকেটে যুক্ত যারা:

২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর পালিয়ে গিয়েছিলেন তারেক রহমানের পিএস, হাওয়া ভবনের দাপুটে ও প্রভাবশালী মিয়া নূর উদ্দিন অপু। দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন মালয়েশিয়ায়। সবকিছু ম্যানেজের পর তিনি বাংলাদেশে ফেরেন। নিয়মিত আসা-যাওয়ায় করছিলন লন্ডনে। কিন্তু গত নির্বাচনের আগ মুহূর্তে মনোনয়ন বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত বিপুল অঙ্কের টাকা লন্ডনে পাচারের প্রাক্কালে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন। অপুর শূন্যস্থান পূরণ করেন হাওয়া ভবনের আরেক প্রভাবশালী আতিকুর রহমান রোমান। ১/১১-এর পর আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া হাওয়া ভবনের কথিত মুখপাত্র আশিকও সিন্ডিকেটে যুক্ত আছেন। মূলত মনোনয়ন ও পদ-পদবী সংক্রান্ত লেনদেনের মধ্যস্থতা করেন রোমান ও আশিক। তাদের মাধ্যমেই ভোঁতা মালেকের হাতে পৌঁছায় টাকা।

এই চক্রের সাথে আরও যুক্ত আছেন আবদুর রহমান সানি। বাংলাদেশে পলিটেকনিকে পড়াশোনা করা সানি যুক্তরাজ্য বিএনপিতে বড়সড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। বিএনপির ‘চিফ এক্সিকিউটিভ’ বলে নিজের পরিচয় দেন তিনি। খালেদা-তারেক-মালেকের পর প্রভাবশালী হিসেবে উঠে এসেছে তার নাম। আর্থিক লেনদেন মালেক সারেন। আর তারেকের সাথে রাজনৈতিক লবিংয়ের চেষ্টা করেন যারা, তাদেরকে আসতে হয় সানির মাধ্যমে। তারেক রহমানের সাথে দলীয় নেতা-কর্মী বা অন্যদের সেতুবন্ধনের কাজটি করেন তিনি। তারেকের দেখা পেতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরকেও ধর্না দিতে হয় সানির কাছে। দলীয় বা অফিসিয়াল পরিচিতি নেই তার। সানির আচরণে কেউ আপত্তি জানালে তারেক সাফ জানিয়ে দেন ও তো দলের কেউ না। তবে সানির দাপটে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও কাবু হয়ে থাকতে হয়।

আরও পড়ুন: দেশে কমিটি বাণিজ্য ও দুর্নীতির টাকায় লন্ডন ক্যাসিনোতে ফূর্তি করছে তারেক

তাকে কেউ বলেন তারেক রহমানের পিএস, কেউ বলেন ড্রাইভার, কেউ বলেন ব্যক্তিগত সহকারী। তবে তার দাপট স্থায়ী কমিটির উপরে। ভোঁতা মালেকের সাথে ক্ষমতার একটা চাপা দ্বন্দ্ব আছে দুজনের মধ্যে। তারেক রহমান যে মঞ্চে বক্তব্য রাখেন সেখানে মঞ্চে পেছনের চেয়ারটি আগে অলিখিত ছিল ভোঁতা মালেকের জন্য। সেই চেয়ার দখলের চেষ্টা ছিল সানির। তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে সানি সেই চেয়ার দখলে পেয়েছেন। আর ভোঁতা মালেক উঠে এসেছেন তারেকের পাশে। তবে অনেকেরই প্রশ্ন, দলীয় বা অফিসিয়াল পদ-পদবী না থাকলে সভা-সমাবেশের মঞ্চে নেতার পেছনে তার ব্যক্তিগত কর্মচারী বসেন কোন শক্তিতে? লন্ডনে অনেক সভায় দেখা গেছে মঞ্চে বসার জায়গা পাচ্ছেন না বর্ষীয়ান নেতারা, অথচ তারেক রহমানের পেছনে সানির চেয়ারটি ঠিকঠাক আছে।

ভোঁতা মালেকের ক্ষমতা বেড়েছে:

ভোঁতা মালেক দিনকে দিন ক্ষমতাশীল হয়ে উঠছেন। নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিবে না বলে দাবি করলেও সবাই জানেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেই। জয়-পরাজয় নিয়ে বিএনপির চিন্তা নেই। তারা ভালো করেই জানে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থান তলানিতে। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে মনোনয়ন বাণিজ্যের লক্ষ্য তারেক রহমানের, সেই বাণিজ্যই বিএনপির টিকে থাকার একমাত্র লাইফ লাইন। ক্ষমতা থেকে বহুদূরে থেকেও তারেক রহমানসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের জীবন-জীবিকা চলে নেতা-কর্মীদের পকেট কেটে লুটে নেয়া টাকায়। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের চাঙ্গা করতেই। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন টিকে না থাকলে কে শুধু শুধু কোটি কোটি টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনবে?

গত নির্বাচনে তারেক রহমান দলের নেতাদের কাছ থেকে মনোনয়ন বাবদ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এ বছর তার লক্ষ্য দ্বিগুণ। লাইনঘাট ঠিক করতে দায়িত্ব পেয়েছেন ভোঁতা মালেক। লন্ডনে আনাগোনা বেড়েছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের। সেই সাথে কয়েকটি জেলায় ছাত্রদল ও যুবদলসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা কমিটির সংক্ষিপ্ত তালিকা নিয়ে লবিং করছেন নেতারা। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বিএনপির অনেক শাখার কমিটি অনুমোদনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সব মিলিয়ে ভোঁতা মালেকের এখন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নাই। যারা তদবির নিয়ে এসেছেন, কেউই খালি হাতে আসেননি। জানেন, খালি হাতে চিড়ে ভিজবে না। তাই মালেককে ম্যানেজ করার মাধ্যমে তারেক ভাইয়ার মন পাবার চেষ্টায় আছেন তারা। সাম্প্রতিক সভা-সমাবেশে আগের চেয়ে বড় গলা শোনা যাচ্ছে ভোঁতা মালেকের।

ভোঁতা মালেক সানি দ্বন্দ্ব পুরনো:

বছরখানেক আগে যুক্তরাজ্য বিএনপির কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে সানির দাপটের বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন যুক্তরাজ্য বিএনপি সভাপতি আব্দুল মালেক ওরফ ভোঁতা মালেক। এক সহকর্মীর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সময় রেকর্ড করেন অপর আরেকজন। মালেক জানাচ্ছিলেন কমিটি গঠনে সানির ভুমিকার কথা। সেই কথোপকথনের অডিও রেকর্ড যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের মোবাইল ও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। দেশ থেকে যাওয়া অনেকে নাকি ভোঁতা মালেকের কাছে না গিয়ে সানির মাধ্যমে লবিংয়ের চেষ্টা করে, এ নিয়ে ক্ষোভ মালেকের। তবে সানি বিষয়টা অস্বীকার করে দায় নিজের ভাই কবীর আহমদের ওপর চাপান। দাবি করেন, নেতা-কর্মীদের সাথে তারেক রহমানের সাথে দেখা-সাক্ষাতের বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন কবীর। এ নিয়ে কবীরেরও বড় ধরণের বাণিজ্যের খবর জানা গেছে।

শোনা যায়, লন্ডনে কবীরের আয়ের মূল উৎস হচ্ছে এই দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা। সানিরও এখানে ‘ইন্টারেস্ট’ আছে বলে শোনা যায়। তাছাড়া সানি ও কবীরের সাথে খালেদা জিয়ারও সম্পর্ক ভালো। এজন্য ভোঁতা মালেক চাইলেও তাদেরকে ধান্দার রাস্তা থেকে হঠাতে পারছেন না কোনভাবেই। দলীয় নেতা-কর্মীরা অসুস্থ বা আহত হয়ে হাসপাতালে গেলে খালেদা জিয়া তাদের দেখতে গেছেন এমন নজির খুব কম। অথচ কয়েক বছর আগে সানির পিতা অসুস্থ হয়ে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তাকে দেখতে যান খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল থেকে শুরু করে স্থায়ী কমিটির অনেকেই। বিএনপির পদ-পদবীহীন নেতা সানির পিতাকে দলবল নিয়ে খালেদা জিয়ার দেখতে যাওয়াতেই অনুমান করা যায় তার প্রভাব কতটা রয়েছে দলে। এ নিয়ে ঈর্ষান্বিত শুধু ভোঁতা মালেক একা নন, আরও অনেকেই আছেন।

হাওয়া ভবন-২ সিন্ডিকেটে আছে জালিয়াত, চোর-বাটপারসহ দাগি আসামীরা:

২০১৩ সালে তারেক রহমানের উপদেষ্টা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন হুমায়ূন কবীর। ২০১৫ জানুয়ারীতে বিএনপির ডাকে অবরোধ কর্মসূচির সময় আমেরিকার ৬ কংগ্রেসম্যানের সাক্ষর জালিয়াতি করে বিবৃতির কথা সবারই মনে আছে। এই সাক্ষর জালিয়াতির মূল হোতা ছিলেন হাওয়া ভবন-২ সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী সদস্য হুমায়ূন কবীর। যদিও আমেরিকায় আরেক উপদেষ্টা সরদার এফ সাদীকে তখন বহিস্কার করে মুখ রক্ষার চেষ্টা করেছিল বিএনপি। কিন্তু স্বাক্ষর জালিয়াতির সাথে যুক্তরাজ্যের মূলধারার পত্র-পত্রিকায় হুমায়ূন কবীরের নাম উঠে আসে। যুক্তরাজ্যে বেড়ে ওঠা হুমায়ূন কবীর এক সময় লেবার পার্টির পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস-এ একটি ওয়ার্ড শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। দলীয় অসদাচরণের কারণে লেবার পার্টি থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়। একরকম ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন হুমায়ূন কবীর। পরে তারেক রহমানের উপদেষ্টা ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন। এর বাইরে তার কোনো পরিচিতি নেই।

এই ভবঘুরে হঠাৎ কীভাবে তারেক রহমানের উপদেষ্টা হিসাবে মনোনীত হলেন- এমন প্রশ্ন অনেকের। তবে কারো কারো মতে, এখানে খেল খেলেছেন ভোঁতা মালেক। তারেক রহমানের বিশেষ উপদেষ্টা পদ পেয়ে হুমায়ূন কবীরের প্রভাব বেড়ে যায়। দলীয় কাউন্সিলে তাকে প্রথমে সহকারি আন্তর্জাতিক সম্পাদক মনোনীত করা হলেও কোনো অদৃশ্য ইশারায় কয়েকদিনের মাথায় পূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পাদক মনোনয়ন দিতে বাধ্য হয় দল। লন্ডনে দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে আলাপে জানা যায়, হুমায়ূন কবীর কথায় কথায় বাংলাদেশে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পশ্চাদ্দেশে লাথি দিয়ে বের করে দেওয়ার নসিহত করেন প্রকাশ্যে। দলের ত্যাগী কর্মীদের দলে কদর না থাকলেও তারেক রহমানের সান্নিধ্যে এসে রাতারাতি দলে এত প্রভাব অর্জন করেন কীভাবে হুমায়ূন কবীররা, এমন প্রশ্ন উঠেছে।

অনেকেই ছাত্রাবস্থা থেকেই বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। অনেক ত্যাগ সয়েছেন জীবনে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই হয়নি এমন অনেকের। অথচ দলে ঢুকেই সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক, দুই দিনের মাথায় পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণ সম্পাদক হওয়া হুমায়ূন কবীররা রাতারাতি হয়ে উঠেছেন প্রভাবশালী। আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে কাকে কাকে কোন দপ্তরের মন্ত্রী বানাবেন- এমন আলোচনা করেন এই ভবঘুরে হুমায়ুন কবীর। নিজেকে ভবিষ্যৎ বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয় দিতেও সাচ্ছ্যন্দবোধ করেন তিনি। আবার কেউ ‘প্রতিমন্ত্রী’ বললেও মাইন্ড করেন। গুঞ্জন রয়েছে, ভোঁতা মালেক নাকি অনেক স্নেহ করেন হুমায়ূন কবীরকে।

লন্ডন বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী মুখ খোলে না হুমায়ূন কবীরের বিরুদ্ধে। কাউকে কাউকে অর্থকড়ি দিয়ে বশ করে রেখেছেন বলে শোনা যায়। তার এত অর্থকড়ির উৎস কী? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারেক রহমানের উপদেষ্টা হওয়ার পর তার আয়ের উৎস ছিল ব্যারিষ্টার জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে নওফেল জমিরের প্রতিষ্ঠিত জমির টেলিকম। যে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতো। কল ট্রাফিকিং করতো মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের পর ধান্দা বন্ধ হয়ে যায় নওফেল জমিরের। তাই হুমায়ূন কবীরেরও পেটে ভাতের সংকট তৈরি হয়। তবে ভিন্ন ধান্দায় ঢুকেছেন তিনি। এখন তার আয়ের উৎস ড্রাগ স্মাগলার হিসাবে খ্যাত এক ব্যবসায়ী। তারেক রহমানের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াই হচ্ছে এই আয়ের উৎস। এই ড্রাগ স্মাগলারের সাথেই তাকে হরদম দেখা যায়। তারেক রহমানকেও দেখা যায় পূর্ব লন্ডনের অলগেইটে ওই ড্রাগ স্মাগলারের মালিকানাধীন এক রেন্টুরেন্টে মাঝে মধ্যেই আসা-যাওয়া করতে। এখানে তারেকের অনেক গোপন আলাপ চলে।

হাওয়া ভবন-২ সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য আবু সায়েম। পেশায় ইমিগ্রেশন আইনজীবী। ক্লায়েন্টদের জাল কাগজ তৈরি করে দেওয়ার অভিযোগে ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিল তাকে। তিনিও তারেক রহমানের উপদেষ্টা। বিএনপিতে হঠাৎ ঢুকে পড়া আবু সায়েমেরও দাপট কম নয়। এই আবু সায়েম এক সময় গণফোরাম করতেন। ড. কামাল হোসেনের অধীনে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। রাজনীতিতে ড. কামালের ভবিষ্যৎ না দেখে লন্ডনে পাড়ি জমান। তারপর ভোঁতা মালেকের সাহচর্যে এসে বিএনপির বিভিন্ন দাগি আসামি ও পলাতকদের লন্ডনে সেটেল করানোর ধান্দায় নামেন। এক পর্যায়ে অবস্থান শক্ত করতে বিএনপিতে নাও ভেড়ান। আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত সুচতুর সায়েম একইসাথে সানির সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। শোনা যায়, সানির মাধ্যমেই তারেকের সান্নিধ্যলাভ করেন এবং একপর্যায়ে উপদেষ্টার পদ বাগিয়ে নেন। বাংলাদেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপরেও খবরদারিও করেন সায়েম। অনুগতদের কাছে প্রচার করে বেড়ান, দল ক্ষমতায় গেলে তিনিই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন।

ভোঁতা মালেকের শক্তির উৎস কী:

যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি আব্দুল মালেক ওরফে ভোঁতা মালেক অত্যন্ত নিচু স্বভাবের একজন মানুষ বলে দলের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে বলেন। তার বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারী, পদ ও মনোনয়ন বিক্রি, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাত্‌, এলাকাপ্রীতি, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর আহমেদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, যুক্তরাজ্য যুবদলের গ্রুপিং ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ইন্ধন এবং যুক্তরাজ্য মহিলা দলে গ্রুপিং সৃষ্টিসহ অসংখ্য অভিযোগ তুলে ধরেছেন খোদ দলের নেতা-কর্মীরা।

যুক্তরাজ্য মহিলা দলের সদস্য সচিব অঞ্জনা আলমের ভাইরাল হওয়া এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে ভোঁতা মালেকের লুচ্চামি সম্পর্কে লিখেছিলেন –

“ভার্চুয়াল সভায় বড় বড় জ্ঞান দিয়ে আবার দলে পদ দেওয়ার নাম করে রাতভর নারী নেত্রীদের সাথে *** করা আবার কোন ধরণের রাজনীতি? আমি সকল বোনদের বলবো এইসব লুচ্চা ফেরাউন। এদের কাছ থেকে দুরে থাকুন। এরা আপনাদের নিয়ে তামশা করবে ব্যবহার করবে কাজ কিছুই করবেনা বরং স্বার্থ শেষ পরে তারাই আপনাদের দুর্নাম করবে। তাই সাবধান আপুরা নিজের ইজ্জত সন্মান বাঁচান। আমরা দলকে প্রাণের চাইতে বেশী ভালোবাসি তাই এই কথাগুলি বলছি। কিছু লুচ্চাদের কারনে অনেক পরিশ্রমী নেত্রীরা আজ অবহেলিত।”

ভোঁতা মালেক বয়সে তারেকের চেয়ে বড়, কিন্তু মালেকের মাথায় স্নেহের হাত রয়েছে তারেকের। মূলত জামায়াতে ইসলাম ও পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র সাথে তারেকের গোপন যোগাযোগের সেতু হলেন ভোঁতা মালেক। লন্ডনে জামায়াতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মালেকের উপস্থিতি অবশ্যই থাকবে। জামায়াতের আরেক নেতা আবু বকর মোল্লা বা সেইভ বাংলাদেশ থিঙ্কট্যাঙ্কের প্রধান ব্যারিস্টার নজরুল ইসলামের সঙ্গেও মালেকের অত্যন্ত ভালো ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এ কারণে যুক্তরাজ্য বিএনপির প্রবীণ নেতারা যখন নানা কারণে জামায়াতের বিভিন্ন অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন, ভোঁতা মালেক উল্টো সব সময় তার গ্যাং নিয়ে হাজির থাকেন। কোনো কারণে তারেক উপস্থিত থাকতে না পারলেও অবধারিতভাবে থাকত ভোঁতা মালেকের এই প্রচ্ছন্ন বার্তা– আমিই তারেক রহমানেরই প্রতিনিধি।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সুইস ব্যাংকে অবৈধ টাকা রাখেন খালেদা জিয়ার বড় পুত্র তারেক রহমান

বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগে ভোঁতা মালেককেই যুক্তরাজ্য বিএনপি’র সভাপতির পদ থেকে অপসারিত করা হলে তিনি গড়ে তোলেন ‘সিটিজেনস মুভমেন্ট’ নামের একটি নাগরিক সংগঠন। যার ব্যানারেই তিনি লন্ডনসহ যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের নানা শহরে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসংখ্য বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে সংগঠনটি নানা জায়গায় কর্মসূচি পালন করেছিল। এমনকি বিভিন্ন ইস্যুতে সিটিজেনস মুভমেন্ট ইউকে লন্ডন ও বার্মিংহামে ভারতীয় দূতাবাসের সামনেও বিক্ষোভ করেছে। সে সময় যুক্তরাজ্য বিএনপির চেয়েও সিটিজেনস মুভমেন্টের সাংগঠনিক শক্তি অনেক বেশি ছিল বলে অনেকে মনে করেন। যার অনেকটাই ভোঁতা মালেকের অর্থবল ও জামায়াতি পেশিশক্তির কারণে। তাছাড়া ছিল খোদ তারেক রহমানের সমর্থনও। যার প্রেক্ষিতে আবারও সভাপতির পদে বহাল হন তিনি।

অনেকের মনে থাকবে, শেখ হাসিনার যুক্তরাজ্য সফরে রাস্তায় রাস্তায় সমাবেশ করেছিল বিএনপি। সেসময় ভোঁতা মালেকের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। অথচ কর্মসূচি শেষে হাইকমিশনে স্মারকলিপি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ হওয়ার পূর্ব ঘোষণা থাকলেও অতি উৎসাহী মালেক ও তার অনুগত সন্ত্রাসী বাহিনী হাইকমিশন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মাথায় কালো পট্টি বেঁধে জঙ্গি চেহারায় ভোঁতা মালেক সাহেব যেভাবে উপস্থিত হন তা নেতা-কর্মীদের জন্য রীতিমতো বিব্রতকর বলে অনেকেরই অভিমত।

ভোঁতা মালেকের নয়া উস্কানি এবং দেশবিরোধী বক্তব্য:

গত দুদিন আগে লন্ডনে একটি সমাবেশ করে বিএনপি। সেখানে অত্যন্ত জঘন্য ও নোংরা সম্বোধনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ কলে গালাগাল করেন ভোঁতা মালেক। সেই সভায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে ভোঁতা মালেক দাবি করেন, একাত্তরে নাকি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করা হয়েছিল। হুমকি দিয়ে ভোঁতা মালেক তারেক রহমানের উপস্থিতিতে জানান দেন, লন্ডনে প্রবাসী সরকার গঠন করে সেখান থেকে নাকি বাংলাদেশকে পরিচালনা করা হবে। দেশে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়ারও ঘোষণা দেন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেছিলেন বলে জঘন্য বক্তব্য দেন মালেক।

[লন্ডনে তারেক জিয়া ও ভোঁতা মালেকের মাফিয়া সাম্রাজ্য এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের গোমর ফাঁস]

শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যম, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, ইইউ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার নাম দিয়ে মিথ্যাচার করে হাস্যকর দাবি করেছেন, তারা নাকি বাংলাদেশকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে নাকি নেতিবাচক কথা বলেছে। যদিও বাংলাদেশে দায়িত্বরত এসব সংস্থার কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই এমনকি এসব তাদের এজেন্ডাও নয়। তারেক রহমানকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকেও উস্কে দেন তিনি। আগামী ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসের পর দেশ দখল করে নতুন বিজয় উদযাপনের হুমকি দিয়েছেন ভোঁতা মালেক।

তার এসব উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দাবি উঠেছে, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার দায়ে ভোঁতা মালেককে আটক করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।

 

আরও পড়ুন:  

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে